টুটুন থেকে মহুয়াঃ একজন প্রতিবেশীর চোখে

 

মহুয়াকে আমি চিনতাম আমাদের পাড়ার নীলুদার মেয়ে হিসাবে। সে তখন ছিল টুটুন, ভাল নাম ছিল শিপ্রা । নাচত। রেকর্ড ড্যান্স, অর্থাৎ রেকর্ড চালি তার সঙ্গে নাচত। হিন্দি বাংলা সব গানের সঙ্গেই। বিভিন্ন শিল্পীর নাচ নিখুঁতভাবে অনুকরণ করতে পারত। পাড়ার মেয়ে, স্বাভাবিকভাবেই পাড়ার সব অনুষ্ঠানেই ওর উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। বহু অনুষ্ঠানে টুটুনকে নিয়ে গিয়েছি। কখনও কিছু পারিশ্রমিক দিয়ে, কখনও কিছু না দিয়েই। ওর বাবার পাশে চুপটি করে বসে থাকত। রোগা ছিপছিপে চেহারা, কতই বা বয়স, দশ কিংবা এগার হবে।


নীলুদা একসময় উদয়শঙ্করের দলে ছিলেন, নাচগানের খুব শখ ছিল, ছবির জগতের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। সেই কারণেই বোধহয় নীলুদা চেয়েছিলেন তাঁর মেয়ে টুটুন নাচগান শিখুক, অভিনয় জগতে একজন সত্যিকারের শিল্পী হয়ে উঠুক। একদিন টুটুন তাই হয়েছে, তার পেছনে ছিল টুটুনের নিষ্ঠা আর নীলুদার প্রেরণা।

দমদম ক্লাইড হাউসের কাছে টেলিফোন কোয়ার্টারে ওরা থাকত। মা ছিলেন টেলিফোন অফিসের কর্মী। ছকবাঁধা জীবন, তাই বাবাই ছিলেন এর সর্বক্ষণের সঙ্গী। নাচের অনুষ্ঠানে কিংবা টালিগঞ্জ- গাড়ায় ছবিতে সুযোগের আশায় ও নীলুদার সঙ্গেই ঘোরাফেরা করত। বাবার হাত ধরে পরিচালক প্রযোজকদের কাছে যাওয়া-আস করতে করতেই ওর মনেও একজন বড় অভিনেত্রী হবার বাসনা দানা বেঁধে ওঠে। অভিনয়কে ভীষণভাবে ভালবেসে, নিজেকে তৈরি করতে থাকে। এরই মধ্যে দমদমের রাধাশ্রী সিনেমা হলে একটা হিন্দি ছবি মুক্তি পেল, নাম 'প্যার'। পরিচালক প্রহ্লাদ শর্মা। সেই ছবিতে নাকি টুটুন আছে! সারা দমদমে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল, সবাই ছুটল টুটুনকে ছবির পর্দায় দেখতে। ছবিটা খুবই নিম্নমানের, কারোরই ভাল লাগল না, তবু টুটুনকে ভাল লাগল। দমদমের মানুষের মনে কিছুটা অহমিকা বোধ জাগিয়ে দিল টুটুন ।


স্মৃতি সাঁতাই বড় বেদনার। আজ লিখতে বসে অনেক কথাই মনে পড়ছে। যদিও ঘনিষ্ঠতা বলতে যা বোঝায় তা ওর বা পরিবারের সঙ্গে আমার ছিল না, তবুও কোথায় যেন একটা আত্মিক যোগাযোগ ছিল। পাড়ার মেয়ে বলেই হয়তো ওর প্রতি আমার একটা আলাদা দুর্বলতা ছিল। দমদমেরই এক ভদ্রলোক একটা কিশোর প্রেমের গল্প লিখলেন। সেই গল্প নিয়ে ছবি করব, এই ভাবনা মাথায় চাপল । টুটুন হবে নায়িকা, নায়ক হবে পার্থ। একদিন আমি আর ক্যামেরাম্যান সুনীল চক্রবর্তী গেলাম ওদের বাড়ি। নীলুদা বাড়িতে ছিলেন না, বউদির সঙ্গেই কথা হল। বউদির মুখেই শুনলাম, তরুণ মজুমদার টুটুনের স্ক্রীন টেস্ট নিয়েছেন তাঁর পরের ছবি 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ'-এর জন্য। সুনীলবাবু ক্যামেরাম্যানের দৃষ্টি দিয়ে ওকে একবার দেখতে চাইলেন। ছাদে পিকনিক করছিল পাড়ার বাচ্চাদের নিয়ে। কিছুক্ষণ পর সারা গায়ে ঝালঝোল মাখা অবস্থায় এসে দাড়াল একটা টেপফ্রক পরা ছোট মেয়ে। সুনীল- বাবু দেখে বললেন, 'ইয়ারে এ যে একেবারেই বাচ্চা'। ঘটনাটি ১৯৭০ সালের গোড়ার। এই হল টুটুন। কোনো এক দৈনিক পত্রিকার দেখলাম লিখেছে ওর বয়স নাকি ৩০ বছর। কী করে হল, হিসাব মেলাতে পারছি না। তরুণবাবুর সেই ছবিতেই ও সুযোগ পেল। শিপ্রা হল মহুয়া রায়চৌধুরী। তারপর ওর এগিয়ে চলার ইতিহাস সকলেরই জানা। ছবির পর ছবি, যশ, খ্যাতি, প্রতিপত্তি।

তারপর ওকে আবার কাছ থেকে দেখবার সুযোগ হল সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে। ও তখন বাংলা চলচ্চিত্রের উঠতি নায়িকা। আমরা তখন বউবাজার অঞ্চলের বাসিন্দা, ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার সামনে একটা রেস্তোরায় আমাদের আড্ডা। বন্ধুবান্ধব সকলের মনেই চলচ্চিত্রকে ঘিরে নানা স্বপ্ন, কেউ অভিনেতা হতে চায়, কেউবা কাহিনীকার, কেউবা 'পরিচালক। সেই ব্যাঙ্ক অব ইণ্ডিয়াতেই চাকরি করে তিলক। এককালের শিশু অভিনেতা মাস্টার তিলক, কিশোর কন্ঠের সুগায়ক তিলক চক্রবর্তী। স্বাভাবিক- ভাবেই তাই তিলকের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ। আমাদের এক বন্ধু সুবোধ নাটক লিখল, 'ভোম্বল ঘটকের কেরামতি (পরে 'ঘটকালি' নামে চলচ্চিত্রে রূপায়িত )। সেই নাটকের মহড়া চলে, অভিনয় হয়, এই সময় তিলকের মনের মানুষ হিসাবে সেখানে টুটুনের আবির্ভাব। টুটুন তখন মহুয়া রায়চৌধুরী|

তারপর একদিন অনেক মানসিক টানা- পোড়েন, ঝড়ঝাপটার মধ্য দিয়ে ওদের বিয়ে হয়। মতাদা, বুড়োদা দাড়িয়ে থেবে সব কিছুর ব্যবস্থা করলেন। বিডন স্ট্রিটে ওরা প্রথম ঘর বাধে। তখনও আমরা গিয়েছি, দেখেছি তিলক-মহুয়ার সুখের সংসার। মহুয়া তখন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, অনেক সময় অনেক অনুরোধ, আবদার নিয়ে আমরা গিয়েছি, কথা রেখেছে, এতটুকু অহমিকাবোধ ওদের মধ্যে দেখিনি। কখনও কোনো অনুষ্ঠানে অতিথি- শিল্পী হয়েছে, কখনও 'ঘটকালি' নাটক করবে বলে বউবাজারের খোলা ছাদের ওপর ঘণ্টার পর ঘন্টা মহড়া দিয়েছে, মুড়ি-চানাচুর ভাগাভাগি করে খেয়েছে, নিজের পয়সা দিয়ে সিঙ্গাড়া মিষ্টি এনে খাইয়েছে। অভিনয়কে মনপ্রাণ দিয়ে ভালবেসেছে, কোনো মোহ বা উচ্চাশায় নয়, অভিনয়কে ভালবেসেই ও বড় অভিনেত্রী হয়েছে।

এরই মাঝে সুবোধের 'ঘটকালি' ছবি হয়েছে। মহুয়া তাতে নায়িকা হয়েছে। আমি একটা ছবি করেছিলাম 'চুপি চুপি', তাতে মহুয়াকে নিতে পারিনি, নিয়েছিলাম সোনালিকে। ছবির শুটিং চলাকালীন এক- দিন স্টুডিও-র মেকআপ রুমে হাসতে হাসতে বলেছিল 'কী ব্যাপার ! দমদমের লোকের ছবিতে আমিই বাদ।' ওকে কিছু বলিনি, হেসে কথাটা হজম করেছিলাম। মনের মধ্যে ইচ্ছা ছিল ভবিষ্যতে ছবি করবার সুযোগ পেলে ওকে নায়িকা করব। কিন্তু মানুষের সব আশা পূর্ণ হয় না, আমারও হল না।

মহুয়া রায়চৌধুরীর কথা বললেন অভিনেত্রী দেবিকা মুখোপাধ্যায়

 মহুয়ার ডাগর-ডোগর মুখটা ক্লোজ আপে কী মিষ্টি লাগত! মহুয়ার রূপে কোনও উগ্রতা ছিল না। গায়ের রং কিন্তু শ্যামলা।  মহুয়ার খুব সাধারণ মধ্যবিত্ত মানসিকতার চেহারা ছিল কিন্তু ক্যামেরার সামনে গ্ল্যামার নিয়ে আসত। এক সাক্ষাৎকারে, দেবিকা মহুয়া সম্পর্কে এই কথাগুলো বলেছিলেন


মহুয়া রায়চৌধুরীর ৪০ তম প্রয়াণ বার্ষিকীতে তাঁর কথা বললেন অভিনেত্রী দেবিকা মুখোপাধ্যায়। ৪০ বছর পর এই প্রথম মহুয়াকে নিয়ে মুখ খুললেন 'ছোট বৌ' দেবিকা। 

মহুয়ার সঙ্গে দেবিকা বললেই তো মনে পড়ে 'আবির' ছবির কথা। যে ছবি মহুয়ার মৃত্যুর দু বছর পর রিলিজ করেছিল। একটু গল্প বলুন না?


আমাকে আগে কেউ কোনওদিন জিজ্ঞেসও করেননি এই বিষয়ে। অথচ মহুয়া আর আমি সহকর্মী ছিলাম এই ইন্ডাস্ট্রিতে।

'আবির' ছবির অফার নিয়ে কিন্তু পরিচালক কাজল মজুমদার মহুয়া মারা যাবার  আমার কাছে এসেছিলেন। মহুয়ার সঙ্গে আমি এই ছবিতে কোনও শুটিং করিনি। কারণ ছবিটা যখন শুরু হয় আমি কোনও গল্পেই ছিলাম না। মহুয়া ছবিটা শেষ করে যেতে পারেনি। তখন ছবিটা শেষ করতে পরিচালক গল্পে আর একটি নায়িকা চরিত্র আমাকে নিয়ে এলেন। 'আবির' ছবিতে দেখা যায় আমার আর মহুয়ার একসঙ্গে দৃশ্য, বেশ কয়েকটা। কিন্তু ওগুলো সব সুচতুর এডিটিং। মহুয়া মারা যাবার পর তো ডিরেক্টর আমায় এই ছবির অফার দেন। আমি এই ছবিতে মহুয়ার সঙ্গে শুটিং করিনি। সেটা দর্শকরা ধরতে পারবেন না। 'আবির' ছবিটা ভালই চলেছিল। অল্প টাকার ছবি, আমরাও তো বেশি টাকা পাইনি সেসময়। কিন্তু চলেছিল। এই ছবিতে মাদ্রাজের একটা বিখ্যাত ট্রেনড কুকুর 'মোতি' ছিল। সে হিন্দি সিনেমাও অনেক করেছিল। যাকে দেখেতেও 'আবির' ছবিটা জনপ্রিয় হয়েছিল।

মহুয়ার সঙ্গে আর কোনও ছবিতে আপনি কাজ করেছিলেন?

হ্যাঁ তপন সিনহার 'রাজা'। একই ছবিতে আমরা দু'জন ছিলাম। তপন সিনহার সঙ্গে কাজ করা আমার কাছে একটা স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। তার আগে 'বাঞ্ছারামের বাগান', 'আদালত ও একটি মেয়ে' করেছি। তবে তপনদার আর একটা ছবিতে আমি হিরোইন ছিলাম। যে রোলটা হিন্দিতে মহুয়া করেছিল। 'আদমি অউর অউরাত' ছবিতে অমল পালেকর আর মহুয়া রায়চৌধুরী ছিল। এই হিন্দি ছবিটার গল্প নিয়ে একটা বাংলা ছবিও হয়েছিল 'মানুষ'। মহুয়ার রোলটা আমি করি আর আমার বিপরীতে ছিলেন শমিত ভঞ্জ। মহুয়া মারা যাবার পর এই বাংলা 'মানুষ' ছবির আমার কাছে আসে। এই ছবিটা মুক্তিও পেয়েছিল পরে। কিন্তু এখন আর কোনও চর্চায় নেই। আমাকে শুধুই 'ছোট বৌ' বলা হয় চিরকাল। অথচ তপন সিনহার এতগুলো ছবি করেছি। 'মানুষ' ছবিতে হিরোইন আমি, তবু কজন আর জানল? ছবিটাই তো পাওয়া যায় না।

মহুয়া আমার থেকে একটু সিনিয়র ছিল। তবে আমার দু'জন দু'জনকে তুই করেই বলতাম। ওঁর চলে যাওয়া বড় মাপের নায়িকার প্রস্থান। ভীষণ ইমোশনাল অ্যাকট্রেস ছিল মহুয়া। গ্লিসারিন ছাড়া কাঁদতে পারত। যেটা এখন কেউ জানেই না, পারেই না। সব চোখে ড্রপ দিয়ে দিয়ে কাঁদে। নিজের বাস্তব জীবনের কষ্টটা মহুয়ার মনে পড়ত। তাই বলত 'কান্নার সিনে আমার গ্লিসারিন লাগে না'। একটা মেয়ে যখন ক্যামেরার সামনে হাউহাউ করে কাঁদতে পারে তখন তো তাঁর ভেতরের যন্ত্রনাগুলো বেরিয়ে আসে। আমিও পারতাম সেটা।আমি মহুয়াকে বলতাম 'আমার ছোটবেলায় বাবা মারা গেছে, বাবার কথা ভেবে আমি কেঁদে ফেলি'। মহুয়াও তখন বলত 'আমার জীবনেও অনেক কষ্ট আছে। সেগুলোর কথা ভেবে আমি কেঁদে ফেলি'।

ওঁর মৃত্যুর ৪০ বছর পরও অমন অভিনেত্রী আর পাওয়া যাবে না। মহুয়ার ডাগর-ডোগর মুখটা ক্লোজ আপে কী মিষ্টি লাগত! মহুয়ার রূপে কোনও উগ্রতা ছিল না। গায়ের রং কিন্তু শ্যামলা।  মহুয়ার খুব সাধারণ মধ্যবিত্ত মানসিকতার চেহারা ছিল কিন্তু ক্যামেরার সামনে গ্ল্যামার নিয়ে আসত। ক্যামেরাতে ভীষণ ( ভীষণে জোর দিলেন দেবিকা) ভাল আসত। কিন্তু খুব ঘর-গেরস্থর মেয়ে ছিল। ওঁকে সামনে দেখলে কেউ বলবে না সিনেমা আর্টিস্ট। একটু ক্ষ্যাপাও ছিল। বাইরে কোথাও রাতে শো করে এসে, স্টুডিওর বাথরুমে স্নান করে নিল। আমি বললাম, 'বাড়ি যাবি না?' বলল 'দূর বাড়ি গিয়ে আবার স্নান কে করে!' স্টুডিওটাকেই মহুয়া ওঁর ঘর সংসার ভেবে ফেলত।

আমরা সহকর্মী ছিলাম। আমার সঙ্গে ওঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল না। রত্না দির (ঘোষাল) যেটা ছিল। কাজ করতে গিয়ে টুকটাক ব্যক্তিগত কথা যা হত। একবার টেকনিশিয়ান স্টুডিওর মেকআপ রুমের ভিতর ঢুকে দেখলাম মহুয়া মেকআপ করছে। আমিও মেকআপে বসব। ওঁর আর আমার আলাদা ছবি ছিল। কিন্তু আমরা এক মেকআপ রুম শেয়ার করছিলাম। তখন দেখি মহুয়ার মুখে মারের দাগ। ঠোঁটের কাছে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। মুখ মার খেয়ে ফুলে রয়েছে। কাটার দাগ। মেকআপ ম্যানকে মুখের দাগগুলো ঢেকে দিতে বলছিল মহুয়া। তখন মহুয়াকে বললাম 'এই অবস্থা তোর কে করল?' বলল 'তিলক, আমার বর!' আমি বললাম তোদের এত ঝগড়া, মারপিট হয় কেন? এত মার খাবি কেন? তখন বলল 'আমি একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছিলাম। সারাক্ষণ টাকা চায়। তাই মারপিট হয়ে যায়।' এটা তো আমি একদিনের ঘটনা বলছি, যা দেখেছিলাম। কিন্তু স্টুডিওপাড়ায় শুনতাম লোকমুখে ওঁরা স্বামী-স্ত্রী দু'জন হামেশাই মারপিট করত। আসলে বেশি জিজ্ঞেস করিনি। আমার তখন অত ম্যাচিউরিটি ছিল না। মহুয়ারও ছিল না। ব্যক্তিগত সংসার জীবন আর প্রফেশনাল জীবন এক করে ফেলত। আমি তাও ওঁকে বুঝিয়েছিলাম। কিন্তু আমার জ্ঞান সেদিন মহুয়া শোনেনি। সংসারে শান্তিটা ওঁর ছিল না। সেটা আমি ওকে দোষ দেব না। ওঁর স্বামীকেও চিনতাম না। আমি বলব আমি জানিনা। যা দেখেছিলাম সেটা খুব কষ্টের। কিন্তু আমি সবসময় ওঁর ভালটা তুলে ধরব। আমি নিজে একজন অভিনেত্রী হয়ে ওঁকে গুণী অভিনেত্রী হিসেবেই দেখব।

আমি তো গিয়েছিলাম তখন মহুয়ার এস এন রায় রোডের বাড়িতে। আমাদের ফিল্মের লোকজন অনেকেই ছিলেন। কিন্তু মহুয়ার মুখ তো ঢাকা ছিল। আগুনে পোড়া শরীর সম্পূর্ণ কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। শবদেহটা দেখেছিলাম কিন্তু আমি তো মহুয়ার মুখ দেখতে পাইনি। সেখানে ওঁর বর, বাবা, ছেলে গোলা সবাইই ছিল। কী ভাবে আগুন লাগল আমি জানিনা। শুনেছিলাম সুইসাইড বা এতটাই অতিরিক্ত মদ্যপান করেছিল যে ছেলের দুধ গরম করতে গিয়ে কখন আগুন লেগে গিয়েছে গায়ে নিজেই বুঝতে পারেনি। ওরকম মৃতদেহর সামনে কী আর এত প্রশ্ন করা যায়! আমি কিছু জিজ্ঞেস করিনি। আমি ভাবতেই পারছিলাম না। ভগবান যাকে যখন নিয়ে নেন। ওঁর মতো অভিনেত্রী আর এল না ইন্ডাস্ট্রিতে।

অদ্বিতীয়া মহুয়া : ছ'জন অভিনেত্রীর চোখে


রত্না ঘোষাল

এগারোই জুলাই বিকেলে মৌ আমার বাড়িতে এসেছিল। এই ঘরে বসেই অনেক আড্ডা হল। সেদিন হেস্পতিবার, 'তপন থিয়েটারে' আমাদের 'নাগপাশ' নাটকের চারশো নাইট-এর উৎসব। সাড়ে পাঁচটার সময় দুজনে একসঙ্গে বেরোলাম। ও বাড়ি চলে গেল। সেদিন মাঝরাতে হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়া! ধড়ফড় করে উঠে জানলা দিয়ে দেখি তিলক, মৌ-এর স্বামী। আগুনে ভয়ঙ্করভাবে পুড়ে যাওয়া মৌকে হাসপাতালে পৌঁছে তিলক এসেছে আমাকে নিয়ে যেতে। তখুনি বেরিয়ে পড়লাম । রাত তখন আড়াইটে। শুনলাম, রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ খাবার গরম করতে গিয়ে কেরোসিনের স্টোভ বার্স্ট করে নাকি এই দুর্ঘটনা !

ক্যালকাটা মেডিক্যাল রিসার্চ ইন্সটিটিউটে যমে মানুষে টানাটানি চলল এগারো দিন। ডাক্তার-নার্সদের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। ওর বাড়ির লোকেদের, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মানুষদের, ওর ভক্ত আর দর্শকদের এত পুজো, মানত এবং আশীর্বাদ, ভালবাসা বিফলে গেল । প্রাথমিক বিপদটা কিন্তু কেটে গিয়েছিল। প্রায় রোজই কথাবার্তা হয়েছিল আমার সঙ্গে শরীরের নাইনটি পার্সেন্ট অংশ পুড়ে গেলেও, দুর্ঘটনার বাহাত্তর ঘণ্টা পর ডাক্তাররা বলেছিলেন, এর সুস্থ হয়ে ওঠার চান্স যথেষ্ট। প্লাস্টিক সার্জারি করে শরীরের পোড়া জায়গা আগের মতো স্বাভাবিক করে ফেলাও কঠিন নয়। রোববার, একুশে জুলাই সকালেও দেখা করেছি এর সঙ্গে, অনেক কথা হয়েছে । তখন একবারও মনে হয়নি, সেটাই শেষ দেখা। সোমবার সকালে টেলিফোন পেলাম, ভোর পাঁচটা পঞ্চান্নতে মৌ চলে গেছে।

আমার ডাকনাম মাটু। মৌ ছিল 'মা' বলতে অজ্ঞান। সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায় একে অপরের কাছে সঁপে দিতাম নিজেদের। যে-কোনো সামান্য সমস্যাতেও মৌ ছুটে আসত আমার কাছে। সেটা বোধহয় ঊনসত্তর সাল, পাইকপাড়ায় আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল ওর মামার বাড়ি। একদিন এসে আলাপ করল আমার সঙ্গে। शি- টারে, সিনেমায় আমার অভিনয় নাকি এর খুব ভাল লাগে। বেশ লাগল মেটোকে ওর ছটফটানি, হুড়মুড় কলা, ছেলে- 1. সহজে যে কোনো মানুষকে আপন করে নেওয়ারও আশ্চর্য ক্ষমতা! বাহাত্তর- তিয়াত্তর সালে মৌ ान । তরুণ মজুমদারের 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ' ছবিতে। তারপর যখন উনিশশো ছিয়াত্তর সালের এপ্রিল মাসে 'তপন থিয়েটারে' সত্য বন্দ্যো পাধ্যায়ের 'নহবত' নাটকে অভিনয় করল, ঘনিষ্ঠতা ও অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব হল। পঞ্চাশ-ষাট নাইট অভিনয় করেছিল আমাদে সঙ্গে, বিয়োর কনে রেখার ভূমিকায়।

মৌ-কে ঘিরে কত স্মৃতি, কত ফোটো। সবই কেমন অগোছালো হয়ে আছে। স্মৃতি হাতড়ে এখন খুঁজে বেড়াচ্ছি আমার প্রিয় বোন, বান্ধবীকে। 'ভারতী' সিনেমার টিকিট কেটে 'দাদার কীর্তি' দেখতে যাওয়া, নিউ মার্কেটে হৈ হৈ করে মার্কেটিং, লেক-মহাদানের মেলায় নাগরদোলায় চাপা--1 ফোটোগুলোও সব অ্যালবামে সাজিয়ে রাখা হয়নি। জানেন, মৌ যখন প্রেম করছে তিলক চক্রবর্তীর সঙ্গে, আমিই ছিলাম ওর গাইড আস্ত ফিলসফার। তর বাবার মত ছিল না এই বিয়েতে। মৌ এসে চেপে ধরল, আমরাই তোড়জোড় করে বিয়েটা দিলাম। ছিয়াত্তর সালের পয়লা মে রেজি সময় দু-পক্ষের অভিভাবক হিসেবে সই করেছিলেন বুড়োদা মানে তরুণকুমার এবং মতাদা। ওহ, মৌ-এর আট বছরের ছেলে তমাল ওরফে গোলা-র জন্য ভীষণ মন খারাপ লাগছে ।...... সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার, থা জুলাই ওর বাংলাদেশে চলে যাবার কথা ছিল, 'উশিলা' ছবির শুটিং করতে। ভিসা না পাওয়ায় যাওয়া হল না। ঢাকায় চলে গেলে হয়তো এভাবে মরতে হত না ওকে। দোসরা জুলাই রাতে মৌ লাস্ট শর্ট দিয়েছে বীরেশ চট্টোপাধ্যায়ের আশীর্বাদ' ছবিতে।

অভিনেত্রী মহুয়া রায়চৌধুরীর তুলনা মহুয়া নিজেই। মৌ হয়তো তথাকথিত গ্ল্যামার-স্টার ছিল না, ওর চেয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রীও টালিগঞ্জে আছেন, কিন্তু শুধুমাত্র অভিনয়ের দিক থেকে ওর ধারে-কাছে আসতে পারেন, এমন নায়িকা এখন বাংলা ছবিতে নেই। নানারকম চরিত্রেই ওকে মানাত, অসাধারণ কাজও করত। সুচি সেন, মাধব মুখোপাধ্যায়, অপর্ণা সেনের পর রোমান্টিক নায়িকা হিসেবেও মৌ-এর তুলনা হয় না। কল্পতরুর 'পরবেশ' বা আরো দু-একটা ছবি ছাড়া, ওর সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ সেভাবে পাইনি, কিন্তু একজন দর্শক হিসেবে ওর ফিল্ম পারফরমেন্স দেখে আমি মুগ্ধ। শঙ্কর ভট্টাচার্যর 'শেষরক্ষা', তরুণ মজুমদারের 'দাদার কীর্তি', পিনাকী মুখোপাধ্যায়ের 'কপালকুণ্ডলা', সলিল দত্তর 'রাজেশ্বরী' বা তপন সিংহর 'আদমি আউর আউরত' ছবিতে মৌ-এর অভিনয় ভুলতে পারব না। কোনোদিন।

দেবশ্রী রায়

কিছু ভাল লাগছে না। বাংলা ছবিতে নায়ক-নায়িকার এত অভাব, তার মধে মহুয়াদির মতো পাওয়ারফুল অ্যাকট্রেস চলে গেলেন। খানিক আগে তনুদা এসেছিলেন। খুব ভেঙে পড়েছেন। রমাপ্রসাদ চক্রবর্তীর 'রেজার সাহেব' ছবিতে প্রথম অভিনয় করেছিলাম মহুয়াদির সঙ্গে। তখন আমি নেহাতই ছোট। অনুদার 'দাদার কীর্তি' ছবির শিমুলতলার আউটডোরেই মহুয়াদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা।

সহশিল্পী হিসেবে অভিনয়ের অনেক খুটিনাটি ব্যাপার শিখতেও পেরেছি এর কাছ থেকে। রোম্যান্টিক চরিত্রে দারুণ লাগত মহুয়াদিকে।

ছেলেবেলায় আমি এবং আমার দিদি মা যখন রুমকি কুকি নামে রেকর্ড-ড্যান্স করতাম বিভিন্ন ফাংশানে মহুয়াদিও তখন রেকর্ড-ড্যান্স প্রোগ্রাম করতেন। মাঝে মাঝেই দেখা হয়ে যেত। ওঁর আসল নাম শিল্পা। সোনালি নামে নাচতেন। অত-শত মনে নেই, মাঝের কাছে শুনেছি, ভীষণ ভাল পারফরমেন্স ছিল মহুয়াদির। यদ অন না আসতেন, হয়তো নৃত্য- শিল্পী হিসেবেই নাম করতেন।'

রুমা গুহঠাকুরতা


মৌ-এর মৃত্যুর খবর পেয়ে বোবা হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর তো দেখা দেখতে গেলাম। সেদিন থেকেই মেন্টালি বড্ড ডিস্‌টার্ব বোধ করছি। মৌ নেই, বিশ্বাস হচ্ছে না। এটা আমার পার্সোনাল লস ও তো আমার বড় মেয়ে, সত্যি সত্যিই মেয়ে আমাকে রুমা-মা বলে ডাকত।

নির্মল মিত্রের 'পরিচয়' ছবির শুটিংয়ে মৌ-এর সঙ্গে আলাপ। এই শিমুলতলার আউটডোরেই ওকে ভালবেসে ফেলেছিলাম । ভারী মিষ্টি মেয়ে, চোখে-মুখে কথা বলত, সহজে আপন করে নিতে পারত সবাইকে। একসঙ্গে প্রথম ছবিতে কাজ করেই বুঝে- ছিলাম, অভিনয়ের সহজাত ক্ষমতা আছে ওর। অসম্ভব প্রতিভাময়ী। পরে আরো দুটো ছবিতে কাজ করেছিলাম ওর মায়ের ভূমিকায় – শঙ্কর ভট্টাচার্যর 'দৌড়', ও তনুবাবুর 'দাদার কীর্তি'। আর এই তো, জুন মাসের শেষাশেষি জহর বিশ্বাসের 'অনুরাগের ছোঁয়া' ছবিতে ওর শাশুড়ির রোল করলাম। একটা ভীষণ সত্য কথা সরাসরি বলা দরকার। রিসেন্ট টাইমস--- ধরা যাক, ষাট দশকের গোড়া থেকে এই পঁচাশি সাল পর্যন্ত যদি হিসেব করি, মাধব মুখোপাধ্যায় ও অপর্ণা সেনের পর এত বড় মাপের অভিনেত্রী বাংলা ছবিতে আর আসেনি। ইয়ং এজে দারুণ দেখতে ছিল আর অপর্ণা তো রূপসী বটেই। মৌ সে তুলনায় খুবই সাধারণ চেহারার। গ্ল্যামারাস সুন্দরী তো ছিল না। তবে ওর আটপৌরে লাবণার টানটাই ছিল অসাধারণ । আর কী চমৎকার, মিষ্টি হাসি! হয়তো শাবানা আজমি বা স্মিতা পাতিলের থেকেও ভাল অভিনেত্রী ছিল মৌ। নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ সেভাবে বড্ড দুঃখী মেয়ে ছিল অনেক চাপা কষ্ট, গোপন বেদনা ছিল ওর মনের গভীরে। আমাকে কখনোই বলেনি কিছু। হয়তো বলতে চায়নি। কিন্তু আমি তো ওর মা ঠিক বুঝতে পারতাম ।


সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়

মহুয়া নিজেই জানত না ও কত বড় অভিনেত্রী ছিল। শঙ্করবাবুর 'দৌড়', তনুদার 'দাদার কীর্তি', নবোদু চট্টোপাধ্যায়ের "আজ কাল পরশুর গল্প' বা তপনদার 'আদমি আউর আউরত' ছবিতে অভিনয়ের জন্য আমাদের মধ্যে চিরকাল বেঁচে থাকবে মহুয়া। সহশিল্পী হিসেবেও বারে বারে টের পেয়েছি এর অসাধারণত্ব। মহুয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় নির্মল মিত্রের 'পরিচয়' ছবির শিমুলোর শুটিংয়ে, বোধহয় পঁচাত্তর সালে। তারপরেও যে কত ছবিতে কাজ করেছি একসঙ্গে। শঙ্করবাবুর 'শেষরক্ষা', দীনেন গুপ্তর 'প্রিয়তমা' ও 'শঠে শাঠাৎ', বিমল রায়ের 'শেষ বিচার', শচীন অধিকারীর 'সমা', অমল দত্তর 'বোধন', অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের 'প্রায়শ্চিত্ত' ও 'কেনারাম বেচারাম',

, বিমল ভৌমিকের 'আমার পৃথিবী', শান্তিময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'তিল থেকে তাল', উমানাথ ভট্টাচার্যর 'প্রেম ও পাপ' বোধহয় আরো দু-চারটে ছবি। নানা রকমের রোল করেছে মহুয়া। কোনো বিশেষ চরিত্রে স্ট্যাম্পড হয়ে যায়নি। হতে দেয়নি। যে কোনো চরিত্রের ভেতরে ঢুকে যেতে পারত অনায়াসে। চরিত্রগুলোর আলাদা ডায়মেনশন দিতে পারত।

কাজ করতে গিয়ে অনেক সময়েই মতের মিল হয়নি মহুয়ার সঙ্গে। ছোটখাটো ঝগড়া বা মনোমালিন্যও হয়েছে। সেসর ভুলে যেতে কিন্তু কারোরই বেশি সময় লাগত না। মহুয়া ছিল একাধারে আমার বোন এবং বান্ধবী। ওর মনটাও ছিল বড়, বিশাল। পশুপাখিদেরও কী ভালবাসত !

অপর্ণা সেন

মধুয়ার মৃত্যু আমাকে কতটা মর্মাহত করেছে, বোকাতে পারব অ্যাকটিং-এর এরকম ম্যাচিওরিটিতে পৌঁছে মেয়েটা চলে গেল। ভাবা যায় না! পঁচাত্তর সালে ইন্দর সেনের 'অসময়' ছবিতে যখন

প্রথম একসঙ্গে কাজ করি, তখনই টের পেয়েছিলাম, মহুয়া খুব ট্যালেন্টেড মেয়ে। কিছুদিন আগে দিলীপ রায়ের 'নীলকণ্ঠ ছবিতেও আবার কাজ করলাম একসঙ্গে। মহুয়া অভিনয় করত একেবারে ভেতর থেকে। হয়তো খুব একটা ভাবনা-চিন্তা না করেই। স্পন্টেনিয়াস। অভিনয়টা এর সহজাত। টাইমিং সেন্স বা সেন্স অব রিদম ছিল অসাধারণ । বেজায় ডাকাবুকো মেয়ে ছিল। নিয়ম-কানুন মেনে চলা পছন্দ করত না। নিয়ম ভাঙতেই যেন আনন্দ । এবং অসম্ভব প্রাণ-প্রাচূর্যে ভরা। এমনিতেই বাংলা ছবি কম দেখি। মহুয়ার অনেক ছবিই দেখিনি। তবে 'অসময়' বা 'দাদার কীর্তি দেখে আই ওয়াজ হাইলি ইমপ্রেসড। নিজের পরিচালিত ছবিতে ওকে ভীষণভাবে ইউজ করার কথা ভেবেছিলাম । সে সুযোগ আর পাব না। তবে আমার 'পরমা' ছবিতে যখন এক বিধবা পাগলি মেয়ের ছোট্ট চরিত্রে কাজ করার অফার দিলাম, রাজি হয়ে গেল। সেটা হয়তো আমার প্রতি ওর শ্রদ্ধা, ভালবাসা বা থে থেকে। ছোট হলেও চরিত্রটা ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা ও টের পেয়েছিল। অভিনয় জানা কোনো মেয়োর দরকার ছিল চরিত্রায়। অ্যাও শি ডিড ইট ভেরি হ্যাপিলি ।

ইন্দর সেন পরিচালিত 'পিপাসা' ছবিতে মহুয়া রায়চৌধুরী ও দীপঙ্কর দে আমাদের ঠিক পরের ব্যাচে যারা এসেছে টালিগঞ্জে, এই ফ্রম দ্য রে আি সেভেন্টিজ, তাদের মধ্যে মহুয়া ছিল সবচেয়ে ট্যালেন্টেড অভিনেত্রী। বেস্ট অব দ্য ট সত্যিই অদ্বিতীয়া।


মাধবী চক্রবর্তী

আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। মহুয়া নেই। ভাবতেই পারছি না ওর হাসি দেখতে পাব না, ওর রাগ দেখতে পাব না। কিছুতেই মনে করতে পারছি না মহুয়া মা বলে ডাকবে না। প্রতিদিন রাত সাড়ে দশটায় মহুয়া কেমন আছে জানবার জে অপেক্ষা করতাম। রত্নার কাছে টেলিফোন করতাম। ওর কাছ থেকে সব খবর নিতাম। আস্তে আস্তে আশা হচ্ছিল ও নিশ্চয়ই ভাল হয়ে যাবে। বেঁচে যাবে। মহুয়াকে হস্ত ভালবাসতাম। ও ছিল আমার বড় মেয়ে। ওকে প্রথম দেখি 'পৃথ্বীরাজ' ছবিতে। সেই ছবিতেই মহুয়াকে আমার ভাল ল তারপর তারকেশ্বরে একটা সিনেমা হাউস উদ্বোধন করতে গিয়ে সরাসরি দেখি মহুয়াকে। দেখলাম ও একমুখ পান নিয়ে চিবুচ্ছে। মুখটা কেমন টকটকে লাল করে একটা ছোট্ট মেয়ে এদিক-ওদিক ঘুরছে। ভারী সুন্দর দেখাচ্ছিল। এরপর সুভাষ ইনস্টিটিউটে 'কলার' নাটক করতে গিয়ে মহুয়ার সঙ্গে আবার দেখা এবং সেই থেকে ঘনিষ্ঠতা শুরু। আমি 'সুবর্ণলতা' ছবির জন্যে মেয়ের ভূমিকায় একটি নতুন মেয়ে দু' বারবার মহুয়ার কথাই আমার মনে হয়েছিল।

ওকে বলতেই ও দারুণ খুশি। 'সুবর্ণলতা'র শুটিংয়ে ওকে আমি প্রতিদিন নিজের হাতে সাজিে দিতাম। 'সাহেব' ছবির শুটিং চলছে। হঠাৎ মহুয়া এসে প্রণাম করল। বললাম, হঠাৎ প্রণাম কেন ? মহুয়া মিষ্টি হেসে বলল, মা, আজ সবচেয়ে বেশি টাকার একটা কনটাক্ট সই করলাম। তাই তোমায় প্রণাম করলাম। মধুয়া ও তিলক যখন-তখন আমার বাড়িতে আসত। শুটিং শেষে ক্লান্ত হয়েও আসত মহুয়া থেকেছে। খেয়েছে। আমার মেয়েদের সঙ্গে এক খাটে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি সকালবেলায় ডেকে দিয়েছি। সকালে খাবার খাইয়ে স্টুডিয়ো পাঠিয়েছি। এমন অনেক ছোট্ট ছোট্ট স্মৃতি মনে পড়ছে। এ তো গেল আমার মেয়ে মহুয়ার কথা। শিল্পী মহুয়ার কথা বলতে গেলে বলতে হয় ওর মতো সুন্দর মুখ আমি আর খুজে পাচ্ছি না। এর অভন ক্ষমতা যে রানি ছিল ा ধারা 'আদমি আউর আওরত' দেখেছেন তারা বুঝতে পারবেন। ও বেঁচে থাকলে আমার থেকে অনেক বড় শিল্পী হতে পারত। মহুয়ার চলে যাওয়ায় বাংলা সিনেমা শিল্পের বড় ক্ষতি হয়ে গেল। মধুয়ার থেকে ভাল শিল্পী আসতে পারে কিন্তু মধুয়া আসবে না। উত্তমবাবু চলে গিয়ে বড় ফাক রেখে গেছেন। মহুয়াও গ্যাপ সৃষ্টি করে গেল। তবে উত্তমবাবু অনেক কিছু দিয়ে গেছেন। আর এই মেয়েটা যখন সবে কাজ শুরু করেছিল তখনই চলে গেল।

এ মৃত্যু বড় কষ্টদায়ক। এর কোনো সান্ত্বনা নেই।

এর সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল অক্ষয় তৃতীয়ার দিন একটি ছবির মহরত অনুষ্ঠানে। দুর্ঘটনার পর প্রথমদিন হাসপাতালে গিয়ে- ছিলাম। রত্না বলল, 'তুমি দেখো না। দৃশ্য তুমি সহা করতে পারবে না।" ভাই ভেতরে না ঢুকেই চলে এলাম।

আশা ও ভালবাসার জোরে সব সময় ভেবেছি ভাল হবে। কিন্তু আর দেখা হল না । মৃত্যুর পরও ওর মুখখানা দেখতে পেলাম না। সাদা চাদর দিয়ে মেয়েটার গোটা শরীরটা ছিল ঢাকা।

দু-সপ্তাহ আগে আমার বাবা ও মাসিকে চিরতরে হারিয়েছি। এদের মৃত্যুর ব্যাপারে আমার মানসিক প্রস্তুতি ছিল, কিন্তু মহুয়া আমায় দারুণ আঘাত দিয়েছে। এখনো পর্যন্ত মহুয়ার চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। কাজকর্ম কিছু ভাল লাগছে না। করতে হয়, করে যা


মহুয়ার মৃতদেহের পাশে টেকনিসিয়ান স্টুডিওতে অশ্রুসজল চোখে উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, রুমা গুহঠাকুরতা, মাধবী চক্রবর্তী ও আরও অনেকে


নিজের সম্পর্কে মহুয়া রায়চৌধুরীর বক্তব্য

  


আমার বাবা নীলাঞ্জন রায়চৌধুরী। অভিনয়ের প্রতি তার একটা অনুরাগ ছিলই, ফিল্মের কাজকর্মের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। তিনি তাঁর নিজের জীবনে যে স্বপ্ন দেখতেন তার অনেকটাই পূরণ করতে চেয়েছিলেন আমার মধ্য দিয়ে। আর তাছাড়া বলতে কি, আমাদের সংসারের অবস্থা তখন খুব একটা ভাল ছিল না। হয়ত ভেবেছিলেন আমি সিনেমায় চান্স পেয়ে গেলে তার আর্থিক দিকেরও কিছু সুরাহা হবে। আমি তখন নাচ শিখতাম—ইচ্ছে ছিল নৃত্যশিল্পী হব। সেটা আর হল না। ফিল্মসেন্স তো দূরে থাক, আমার যখন অভিনয় সম্পর্কেই বিশেষ কিছু আগ্রহ জন্মায়নি, বাবা তখন থেকেই আমাকে সিনেমার নামাবার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। বলা বাহুল্য সেই সময়েই মেয়ের জনে। তাঁকে কিছু গল্পনা-লাঞ্ছনা সইতে হয়েছিল। ছেলেমানুষ হলেও সেটা বোঝার মত বয়েস আমার ছিল। যেমন ধরুন, বাবা আগেভাগে কথা বলেই কোনো পরিচালকের কাছে আমাকে নিয়ে গিয়েছেন-তো তিনি আমাকে দেখে একেবারেই বিরূপ আশাহত মন্তব্য করে বসলেন- এই আপনার ে কি হবে একে দিয়ে ভাল করে লেখাপড়া শেখান বিয়েথা দিন ইত্যাদি ।


বাবা আমার কাছে ধরা দিতে না চাইলেও লক্ষ্য করতাম প্রায় ধিকার প্ররূপ। । এইসব মন্তব্য শুনে বাবার মুখ শুকিয়ে যেত। তার কিছু নয়, সেটা দেখে আমার আত্মসম্মানে য লাগত। বাবাকে বলতাম- হ্যাঁ গো তুমি কি? আমাকে এইভাবে লোকের কাছে নিয়ে যাও, তারা আমার সঙ্গে তোমাকেও অপমান করে। চল বাড়ি চল, আমার কোনো দরকার নেই সিনেমা করবার।

কতদিন এমন হয়েছে, প্রায় কান্না এসে গেছে চোখে। বাবা কিন্তু দমতেন না, বরং আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে হাসতে হাসতে বলতেন—দূর কে কি বলল তাতেই এত চটে যেতে হয় নাকি তোর আবার এইটুকু বয়েসেই বেশি প্রেস্টিগমন। হয়ত সেটা ছিল, তাই ছোটবেলায় আমাকে সবাই ডাকত 'প্রেস্টিজ কুকার' বলে। বাবাও এই বলে খ্যাপাতেন তখন । আর বলতেন-কে তোকে ফিরিয়ে | দিল তাতেই তোর কিছু হবে না এটা ধরে আসলে তার নিজের মনের জেদটাকেই ফিরিয়ে আনার জানো। আর সেটা শেষ পর্যন্ত ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন বলেই তো এই আজকের আমি জানবেন, পারিবারিক দিক থেকে এই আমি সম্পূর্ণই আমার বাবার। তার স্বপ্ন কতটা সার্থক করতে পেরেছি জানি না, তবে নিশ্চয়ই কিছুটা পেরেছি। এটা ভেবে আমার আনন্দ হয়, অন্যদিকে কখনও-সখনও একটু মন খারাপ হয় বইকি, যখন ভাবি আমার মা। মাধবীলতা রায়চৌধুরী কিন্তু আমাকে একেবারেই অন্যভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। আমাকে ঘিরে আমার মা-বাবার স্বপ্ন ছিল একেবারেই বিপরীতমুখী।

মা নিজে যথেষ্ট শিক্ষিতা, মহিলা হয়েও অনির্ভর, এখনও চাকরি করেন। তিনি চেয়েছিলেন আমি মন দিয়ে লেখাপড়া করি। আমার ফিল্ম লাইনে আসাটা আদৌ পছন্দ ছিল না তার। অনেকেই জানেন না, আমি খুব ছোট বয়েসে দুটি হিন্দি ছবিতে নেমেছিলাম—সেসব 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ'-এরও আগে। এই ছবি দুটিতে আমার নাম দেওয়া হয়েছিল বেবি সোনালি আসলে আমার নাম শিপ্রা। মেয়ের নাম সিনেমায় ব্যবহার হবে, মা এটা চাননি। আমার 'মহুয়া' নামটা তো আমার আরেক জন্মদাতার, আপনারা জানেন স্টুডিয়োর লোকজনদের কাছে, যিনি "তনুবাবু' নামে পরিচিত অর্থাৎ তরুণ মজুমদারের দেওয়া। কোন দূরদর্শিতায় জানি না, উনিই তো প্রথম আমার সম্ভাবনার কথা টের পেয়েছিলেন। 

মহুয়ার জীবন অবলম্বনে তৈরি হচ্ছে বায়োপিক যেখানে নামভূমিকায় অভিনয় করবেন অঙ্কিতা মল্লিক

 টলিউডের একসময়ের অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেত্রী ছিলেন মহুয়া রায়চৌধুরী। তাঁর অভিনয় জীবনে দর্শকদের উপহার দিয়েছেন একের পর এক সফল ও স্মরণীয় সিনেমা। যদিও তাঁর আকস্মিক প্রয়াণ এখনও ভোলেননি বাংলা সিনেমার অনুরাগীরা। মৃত্যুর চার দশক পেরিয়ে গেলেও, আজও দর্শকমনে তিনি সমান উজ্জ্বল ও প্রাসঙ্গিক।


তাঁর অকাল মৃত্যু ঘিরে আজও তৈরি হয় অসংখ্য প্রশ্ন, যা ঘোর কাটায় না অনুরাগীদের। ঠিক কী হয়েছিল সেই রাতে? কী ছিল মহুয়া রায়চৌধুরীর অকাল মৃত্যুর নেপথ্যে?

এই রহস্য ও আবেগঘন অধ্যায় নিয়েই এবার বড় পর্দায় আসছে তাঁর জীবনীচিত্র—যা তুলে ধরবে সেই অধরা সত্যের খোঁজ।

অভিনেত্রী মহুয়া রায়চৌধুরীর ৬৭তম জন্মদিনে এক বড় ঘোষণার মাধ্যমে চমক দিলেন পরিচালক সোহিনী ভৌমিক। মহুয়ার জীবন অবলম্বনে তৈরি হচ্ছে বায়োপিক, যেখানে নামভূমিকায় অভিনয় করবেন টেলিভিশনের জনপ্রিয় মুখ ‘জগদ্ধাত্রী’ খ্যাত অঙ্কিতা মল্লিক।

এই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে উচ্ছ্বসিত অঙ্কিতা। সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালের সঙ্গে কথায় তিনি বলেন, “রানা দা-র কাছ থেকেই অফারটা পাই। তিনি আমাকে এই চরিত্রের জন্য ভেবেছেন—এটাই আমার কাছে অনেক বড় ব্যাপার। এমন একটি চরিত্রে, তাও আবার নিজের প্রথম ছবিতে কাজ করার সুযোগ পাওয়া সত্যিই সৌভাগ্যের। মহুয়া রায়চৌধুরীর মতো একজন আইকনিক অভিনেত্রীর চরিত্রে অভিনয় করা একদিকে যেমন সম্মানের, অন্যদিকে তেমনই চ্যালেঞ্জেরও।”

তবে কবে থেকে শুটিং শুরু হবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। ধারাবাহিকের পাশাপাশি সিনেমার কাজ কীভাবে সামলাবেন, তা এখনই ভাবছেন না অঙ্কিতা। আপাতত তিনি শুধু নিশ্চিত—“ছবিটা করছি, এটুকুই জানি।”

পর্দায় মহুয়া রায়চৌধুরীর চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ—অঙ্কিতা মল্লিকের কাছে নিঃসন্দেহে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। প্রথম ছবিতেই এতটা গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে আপ্লুত ‘জগদ্ধাত্রী’ খ্যাত অভিনেত্রী।

উল্লেখযোগ্য, জি বাংলার জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘জগদ্ধাত্রী’-তে জ্যাস সান্যাল চরিত্রে ইতিমধ্যেই দর্শকের মনে পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছেন অঙ্কিতা। ড্রয়িং রুমের চেনা মুখ এবার বড়পর্দায় ধরা দেবেন এক নতুন, গভীরতর চরিত্রে। মহুয়া রায়চৌধুরীর মতো এক আইকনিক অভিনেত্রীর ভূমিকায় তাঁকে দেখার অপেক্ষায় এখন অনুরাগীরা।

নিজের চরিত্র এবং প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত অঙ্কিতা। দর্শকদের সামনে এক ভিন্ন ছায়ায় ধরা দিতে চলেছেন তিনি। টেলিভিশনের গণ্ডি পেরিয়ে এবার বড়পর্দায় এক নতুন চমক দিতে প্রস্তুত এই তরুণ অভিনেত্রী।

শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ মুক্তির বছরখানেক পর মহুয়া রায়চৌধুরীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার

 বাংলা ছবির সেই সময়কার অন্যতম জনপ্রিয় নায়িকা ছিলেন তিনি। তাঁর নামে প্রেক্ষাগৃহ হাউজ়ফুল হতো। প্রথম ছবি ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ মুক্তির বছরখানেক পর মহুয়া রায়চৌধুরীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন নির্মল ধর।



নির্মল ধর: ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ ছবিতে যখন অভিনয় করেন, তখন আপনার বয়স কত?

মহুয়া: তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। বয়স আর কত হবে? আটান্ন সালে জন্ম। (জন্ম তারিখ জিজ্ঞাসা করায় পাশে বসা বাবা বললেন ছাপান্ন সাল। মা বললেন, না আটান্ন) আসলে বয়স বাড়িয়ে বা লুকিয়ে বলার কারণ কি জানেন? আমাকে সকলেই খুব বেশি বয়সী বলে ভেবে নেয়। আমার এখন সতেরো চলছে। কালকেই (২৬ সেপ্টেম্বর) জন্মদিন গেল।

প্রশ্ন: ফিল্মে কাজ করতে এসে পড়াশুনোর ক্ষতি হচ্ছে না?

মহুয়া: অসুবিধা তেমন কিছু হচ্ছে না। কাজের চাপে স্কুল ছেড়ে দিতে হয়েছে, এই আর কী! বাড়িতে টিউটরের কাছে নিয়মিত পড়ছি। সেভেনটি ফাইভে স্কুল ফাইনাল দেব। স্টুডিয়োয় যখন কাজ করি, কাজই করি। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। অসুবিধে কী হবে?

প্রশ্ন: ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এর শেষে আপনার এবং অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা চুম্বন দৃশ্য ছিল। সেটা সাজেশনে দেখিয়েছেন পরিচালক তরুণ মজুমদার। ওই দৃশ্যে অভিনয়ের আগে তরুণবাবু আপনাকে কীভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন?

মহুয়া: সত্যি কথা বলতে কী তরুণবাবু আমার কাছে কিছুই লুকোননি। পায়ের ওপর পা দিয়ে দাঁড়ালে দৃশ্যটার যে কী মিনিং হবে তা আমাকে বলে দিয়েছিলেন। আমারও খুব একটা অসুবিধা হয়নি। কারণ, এটা তো ঠিক, আগেকার দিনের ওই বয়সের মেয়ের চাইতে আজকালকার মেয়েরা অনেক বেশি জানে এবং বোঝে। প্রথমটায় একটু দ্বিধা-লজ্জা নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু আনন্দও কম ছিল না।

প্রশ্ন: বাংলা ছবিতে তাহলে চুম্বন দৃশ্য আসুক আপনি চান?

মহুয়া: হ্যাঁ, চাইব না কেন? তবে সুন্দরভাবে আসুক, অশ্লীলভাবে নয়। ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এই যেমন সিম্বল দিয়ে দেখানো হয়েছে, তেমন করেই হোক। ক্ষতি কি? ফেস-টু-ফেস কিসিং দেখাতেই হবে এমন তো কথা নেই! শৈল্পিক ভঙ্গিতে দেখানো চুম্বন দৃশ্য খারাপ লাগবে না।

প্রশ্ন: তরুণ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ফিল্ম ইনস্টিটিউট বা ওই জাতীয় কোনও প্রতিষ্ঠান থেকে ফর্মাল ট্রেনিং থাকা কি অবশ্য দরকার?

মহুয়া: না, মোটেই না। আগেকার সব বিখ্যাত শিল্পীরা প্রায় কেউই কোনও ট্রেনিং পাননি। তাঁরা অভিনয় শিখেছেন কি করে? আসলে দরকার অভিনয়-ক্ষমতা। ওই জিনিসটা থাকলেই চলবে। না হলে সবই ফক্কা। প্রতিবছর তো পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে গুচ্ছের ছেলেমেয়ে পাশ করছে। বলুন তো, তাদের মধ্যে সবাই কি দাঁড়াতে পারছে? তবে হ্যাঁ, একটা তকমা থাকলে চান্স পাওয়া যায় মাঝেমধ্যে।

প্রশ্ন: অভিনয় সম্পর্কে থিয়োরিটিকাল বা প্র্যাকটিকাল কোনও অভিজ্ঞতারই প্রয়োজন নেই, আপনি এ কথাই বলতে চান?

মহুয়া: হ্যাঁ, মোটামুটি তাই বলতে চাই। পড়াশুনো করে যেটুকু জানার সেটা না জানলে খুব একটা ক্ষতি আছে কি? বরং অভিনয়ের প্র্যাকটিস করতে পারলে কাজ হয়।

প্রশ্ন: স্কুলে নিশ্চয়ই ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য কী’ বা ওই জাতীয় কোনও রচনা লিখেছেন। কী লিখেছিলেন তখন?

মহুয়া: ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছি স্কুলে। নাইনে উঠে ছেড়ে দিয়েছি। ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য’ নামে কোনও রচনা সৌভাগ্যক্রমে আমাকে লিখতে হয়নি। তবে ছোটবেলায় ভয়ানক ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হব। ডাক্তারদের বেশ থ্রিলিং লাইফ, তাই না?

প্রশ্ন: ডাক্তার তো হতে পারলেন না। আপশোস হচ্ছে না?

মহুয়া: হচ্ছে তো বটেই। কিন্তু এখন তো আর ডাক্তার হতে পারব না। ফিল্ম লাইনে চলে এসেছি। জেনারেল পড়াশুনাই চালাতে হচ্ছে প্রচণ্ড খেটে। তার ওপর আবার ডাক্তারি! হবে না। তবে কী জানেন, আমি অঙ্কে আর বিজ্ঞানে খুব ভালো ছিলাম। অঙ্কে আটের ঘরে আর বিজ্ঞানে ছয়ের ঘরের নীচে কোনওদিন নম্বর পাইনি। কিন্তু কী আর হবে! ভাগ্য সব পাল্টে দিচ্ছে!

প্রশ্ন: ফিল্মে অভিনয় করার ব্যাপারে বাড়ির কারওর  অমত ছিল? বা এখনও আছে কি?

মহুয়া: তেমন জোরাল কোনও অমত কারওর ছিল না। বলতে গেলে বাবার আপ্রাণ চেষ্টাতেই আজ আমি ফিল্মে চান্স পেয়েছি এবং পাচ্ছি। প্রথমটায় মায়ের একটু অমত ছিল। মৃদু আপত্তিও জানিয়েছিলেন। এখন অল কোয়ায়েট ইন দ্য হোম ফ্রন্ট বলতে পারেন।

প্রশ্ন: অভিনয়ের প্রতি আপনার আকর্ষণ এল কীভাবে বা কার কাছ থেকে?

মহুয়া: ছোটবেলায় পাড়ায় বিভিন্ন ফাংশনে নাচতাম। স্কুলেও নাটক করেছি দু’-একটা। বাবা আমার এই নাচের ব্যাপারটাকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আমাকে ফিল্মে নামাবার জন্য তিনিই বহুদিন ধরে বহু লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন। তাঁর চেষ্টা আজ সফল হতে চলেছে, এটাই আমার আনন্দের বিষয়।

প্রশ্ন: যদিও বেশিদিন কাজ করছেন না, তবুও এই অল্প ক’দিনে ফিল্ম লাইন সম্পর্কে আপনার কী ধারণা হয়েছে যদি অল্পকথায় বলেন?

মহুয়া: ফিল্ম লাইন সম্পর্কে বাইরের লোক হিসেবে খুব একটা পরিষ্কার ধারণা আমার ছিল না। এখনও যে ধারণাটা খুব স্পষ্ট, তা বলতে পারছি না। তবে এ লাইনে ভালো লোক যেমন আছেন, খারাপ লোকেরও অভাব নেই। খুব সাবধানে চলতে হচ্ছে। অনেকেই কথা দিয়ে কথা রাখেন না। এটাই খারাপ লাগে। এই তো কিছুদিন আগে একজন পরিচালক তাঁর ছবির জন্য আমাকে ঠিক করলেন। ক’দিন রিহার্সালও দিলাম। তারপর হঠাৎ কাগজে দেখলাম শিল্পী তালিকায় আমার নাম নেই। তা নিয়ে আমি কোনওদিন অভিযোগ করিনি কারওর কাছে। সেই পরিচালককেও কিছু বলিনি। আমার রিঅ্যাকশন তাঁকে বুঝতেই দিইনি। যা আছে আমার মনের মধ্যেই আছে। বরং একদিন রাস্তায় সেই পরিচালককে হন্যে হয়ে ট্যাক্সি খুঁজতে দেখে আমার গাড়িতে লিফট দিয়েছি। উনি সেদিন গাড়িতে বসে আমাকে বলেছিলেন, ‘মহুয়া, তোমাকে নিলেই বোধহয় ভালো হত। ছবিটা রিলিজ় করে যেত এতদিনে।’ এই ধরনের কথা দিয়ে কথা না রাখা ব্যাপারটা বড় খারাপ লাগে।

প্রশ্ন: ফিল্মের কোনও হিরো আপনাকে প্রেম নিবেদন করেছে এখনও পর্যন্ত?

মহুয়া: হ্যাঁ, সেরকম প্রস্তাব পেয়েছি। কিন্তু নামটা আমি বলতে পারব না। কাইন্ডলি অনুরোধ করবেন না।

প্রশ্ন: আপনার রিঅ্যাকশন কীরকম?

মহুয়া: ফিল্ম হিরোদের প্রেম সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই। এদের বেশিরভাগেরই চোখে একটা রঙিন চশমা আঁটা থাকে। আজ এই হিরোইনকে ভালো লাগে, কাল আমাকে, পরশু অন্য কাউকে। আসলে এদের চাহিদাটা একটা জায়গাতেই সীমাবদ্ধ। ফিল্ম হিরোর সঙ্গে প্রেম আমি ভাবতেই পারি না।

প্রশ্ন: তাহলে আপনার প্রেমের লাইফ ফিল্ম লাইনের বাইরেই থাকছে?

মহুয়া: হ্যাঁ, তাই।

প্রশ্ন: ফিল্ম লাইনের বাইরে কেউ আপনাকে প্রেম নিবেদন করেছে কি?

মহুয়া: আপাতত তেমন কেউ নেই। থাকলেও বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা একান্তই ব্যক্তিগত এবং গোপনীয়। এর চাইতে বেশি আর কিছু বলতে পারব না।

প্রশ্ন: বাড়িতে আপনার বাবা-মা কি আপনাকে ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছেন?

মহুয়া: এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলি। আমার বাবা-মা কেউই তেমন অতিআধুনিক মাইন্ডেড নন। কিছু সংস্কার তাঁদের মধ্যে আছেই। তবুও আমার জীবনের কোনও ডিসিশন নেওয়ার আমার যেমন অধিকার আছে, বাবা-মায়ের মতকেও একেবারে উড়িয়ে দিতে পারব না। কিছু করার আগে একটু ভাবব। তবে কী না সবকিছুই সময়ের ওপর নির্ভর করে।

প্রশ্ন: উত্তমকুমার সম্পর্কে আপনার নিশ্চয়ই একটু বেশিই ঔৎসুক্য ছিল। এখন তো তাঁর সঙ্গে অভিনয় করছেন। ভাবতে কেমন লাগছে?

মহুয়া: সত্যি কথা বলতে কী, উত্তমকুমার বলতে মেয়েরা যেমন পাগল হয়ে যায়, আমি তেমন কোনওদিনই ছিলাম না। আমাদের পাড়ায় বহু ছবির শুটিং হয়েছে। পাড়ার সবাই ঝেঁটিয়ে গিয়েছে উত্তমকুমারকে দেখতে। মেয়েদের মধ্যে সে কী উত্তেজনা! আমি কিন্তু তেমন উৎসাহ পেতাম না। এখন তাঁর সঙ্গে অভিনয় করছি। ভাবলে আনন্দ লাগে অবশ্যই। ওঁর সঙ্গে কাজ করে আমি শিখছিও অনেক কিছু।


প্রশ্ন: কথায়-কথায় আসল ব্যাপারটা জানা হল না। ফিল্ম লাইনে আগে থেকে তো আপনার জানাশোনা কেউ ছিল না। তাহলে সুযোগ পেলেন কীভাবে?

মহুয়া: কোথা থেকে শুরু করব তাই ভাবছি। ঘটনা তো অনেক। ‘নয়া মিছিল’ ছবির একটা চরিত্রের জন্য মেক-আপ টেস্ট দিতে গিয়েছিলাম। পরিচালক পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়ের পছন্দ হল না। তখন মেক-আপম্যান জামাল সাহেব আমাকে তরুণবাবুর কাছে পাঠালেন। গেলাম। উনি দেখে-টেকে বললেন, ‘খবর দেব।’ এর আগেই অবশ্য গায়িকা বনশ্রী সেনগুপ্ত আমার একখানা ছবি তরুণবাবুকে দিয়েছিলেন। খবর পেলাম তরুণবাবু আমাকেই সিলেক্ট করেছেন। অবশ্য এতসব যোগাযোগের পিছনে বাবার আপ্রাণ পরিশ্রমটাই কাজ করেছে বেশি।

প্রশ্ন: আপনার সমসাময়িক নতুন নায়িকাদের সঙ্গে আপনি কোনও প্রতিযোগিতার ভাব বুঝতে পারছেন কি?

মহুয়া: না, তেমন কিছু আমি ফিল করিনি এখনও। আমার বয়স তো খুবই অল্প আর যাঁরা আছেন তাঁদের সঙ্গে এখনও আমার কম্পিটিশনের ব্যাপারটা আসেনি। যে ধরনের চরিত্র আমি করছি, সেখানে আমার বয়সি শিল্পীই বা কোথায়? অনেকেই আমার চাইতে বয়সে ও অভিজ্ঞতায় বড়।

প্রশ্ন: আপনার সাফল্য-ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?

মহুয়া: ছবিতে কাজ করছি, সবাই ভালো বলছেন। এটাই ভালো লাগছে। তবে আমি নিজে সন্তুষ্ট নই। বেশি আর কী বলতে পারি!

টুটুন থেকে মহুয়াঃ একজন প্রতিবেশীর চোখে

  মহুয়াকে আমি চিনতাম আমাদের পাড়ার নীলুদার মেয়ে হিসাবে। সে তখন ছিল টুটুন, ভাল নাম ছিল শিপ্রা । নাচত। রেকর্ড ড্যান্স, অর্থাৎ রেকর্ড চালি তা...