টুটুন থেকে মহুয়াঃ একজন প্রতিবেশীর চোখে

 

মহুয়াকে আমি চিনতাম আমাদের পাড়ার নীলুদার মেয়ে হিসাবে। সে তখন ছিল টুটুন, ভাল নাম ছিল শিপ্রা । নাচত। রেকর্ড ড্যান্স, অর্থাৎ রেকর্ড চালি তার সঙ্গে নাচত। হিন্দি বাংলা সব গানের সঙ্গেই। বিভিন্ন শিল্পীর নাচ নিখুঁতভাবে অনুকরণ করতে পারত। পাড়ার মেয়ে, স্বাভাবিকভাবেই পাড়ার সব অনুষ্ঠানেই ওর উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। বহু অনুষ্ঠানে টুটুনকে নিয়ে গিয়েছি। কখনও কিছু পারিশ্রমিক দিয়ে, কখনও কিছু না দিয়েই। ওর বাবার পাশে চুপটি করে বসে থাকত। রোগা ছিপছিপে চেহারা, কতই বা বয়স, দশ কিংবা এগার হবে।


নীলুদা একসময় উদয়শঙ্করের দলে ছিলেন, নাচগানের খুব শখ ছিল, ছবির জগতের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। সেই কারণেই বোধহয় নীলুদা চেয়েছিলেন তাঁর মেয়ে টুটুন নাচগান শিখুক, অভিনয় জগতে একজন সত্যিকারের শিল্পী হয়ে উঠুক। একদিন টুটুন তাই হয়েছে, তার পেছনে ছিল টুটুনের নিষ্ঠা আর নীলুদার প্রেরণা।

দমদম ক্লাইড হাউসের কাছে টেলিফোন কোয়ার্টারে ওরা থাকত। মা ছিলেন টেলিফোন অফিসের কর্মী। ছকবাঁধা জীবন, তাই বাবাই ছিলেন এর সর্বক্ষণের সঙ্গী। নাচের অনুষ্ঠানে কিংবা টালিগঞ্জ- গাড়ায় ছবিতে সুযোগের আশায় ও নীলুদার সঙ্গেই ঘোরাফেরা করত। বাবার হাত ধরে পরিচালক প্রযোজকদের কাছে যাওয়া-আস করতে করতেই ওর মনেও একজন বড় অভিনেত্রী হবার বাসনা দানা বেঁধে ওঠে। অভিনয়কে ভীষণভাবে ভালবেসে, নিজেকে তৈরি করতে থাকে। এরই মধ্যে দমদমের রাধাশ্রী সিনেমা হলে একটা হিন্দি ছবি মুক্তি পেল, নাম 'প্যার'। পরিচালক প্রহ্লাদ শর্মা। সেই ছবিতে নাকি টুটুন আছে! সারা দমদমে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল, সবাই ছুটল টুটুনকে ছবির পর্দায় দেখতে। ছবিটা খুবই নিম্নমানের, কারোরই ভাল লাগল না, তবু টুটুনকে ভাল লাগল। দমদমের মানুষের মনে কিছুটা অহমিকা বোধ জাগিয়ে দিল টুটুন ।


স্মৃতি সাঁতাই বড় বেদনার। আজ লিখতে বসে অনেক কথাই মনে পড়ছে। যদিও ঘনিষ্ঠতা বলতে যা বোঝায় তা ওর বা পরিবারের সঙ্গে আমার ছিল না, তবুও কোথায় যেন একটা আত্মিক যোগাযোগ ছিল। পাড়ার মেয়ে বলেই হয়তো ওর প্রতি আমার একটা আলাদা দুর্বলতা ছিল। দমদমেরই এক ভদ্রলোক একটা কিশোর প্রেমের গল্প লিখলেন। সেই গল্প নিয়ে ছবি করব, এই ভাবনা মাথায় চাপল । টুটুন হবে নায়িকা, নায়ক হবে পার্থ। একদিন আমি আর ক্যামেরাম্যান সুনীল চক্রবর্তী গেলাম ওদের বাড়ি। নীলুদা বাড়িতে ছিলেন না, বউদির সঙ্গেই কথা হল। বউদির মুখেই শুনলাম, তরুণ মজুমদার টুটুনের স্ক্রীন টেস্ট নিয়েছেন তাঁর পরের ছবি 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ'-এর জন্য। সুনীলবাবু ক্যামেরাম্যানের দৃষ্টি দিয়ে ওকে একবার দেখতে চাইলেন। ছাদে পিকনিক করছিল পাড়ার বাচ্চাদের নিয়ে। কিছুক্ষণ পর সারা গায়ে ঝালঝোল মাখা অবস্থায় এসে দাড়াল একটা টেপফ্রক পরা ছোট মেয়ে। সুনীল- বাবু দেখে বললেন, 'ইয়ারে এ যে একেবারেই বাচ্চা'। ঘটনাটি ১৯৭০ সালের গোড়ার। এই হল টুটুন। কোনো এক দৈনিক পত্রিকার দেখলাম লিখেছে ওর বয়স নাকি ৩০ বছর। কী করে হল, হিসাব মেলাতে পারছি না। তরুণবাবুর সেই ছবিতেই ও সুযোগ পেল। শিপ্রা হল মহুয়া রায়চৌধুরী। তারপর ওর এগিয়ে চলার ইতিহাস সকলেরই জানা। ছবির পর ছবি, যশ, খ্যাতি, প্রতিপত্তি।

তারপর ওকে আবার কাছ থেকে দেখবার সুযোগ হল সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে। ও তখন বাংলা চলচ্চিত্রের উঠতি নায়িকা। আমরা তখন বউবাজার অঞ্চলের বাসিন্দা, ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার সামনে একটা রেস্তোরায় আমাদের আড্ডা। বন্ধুবান্ধব সকলের মনেই চলচ্চিত্রকে ঘিরে নানা স্বপ্ন, কেউ অভিনেতা হতে চায়, কেউবা কাহিনীকার, কেউবা 'পরিচালক। সেই ব্যাঙ্ক অব ইণ্ডিয়াতেই চাকরি করে তিলক। এককালের শিশু অভিনেতা মাস্টার তিলক, কিশোর কন্ঠের সুগায়ক তিলক চক্রবর্তী। স্বাভাবিক- ভাবেই তাই তিলকের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ। আমাদের এক বন্ধু সুবোধ নাটক লিখল, 'ভোম্বল ঘটকের কেরামতি (পরে 'ঘটকালি' নামে চলচ্চিত্রে রূপায়িত )। সেই নাটকের মহড়া চলে, অভিনয় হয়, এই সময় তিলকের মনের মানুষ হিসাবে সেখানে টুটুনের আবির্ভাব। টুটুন তখন মহুয়া রায়চৌধুরী|

তারপর একদিন অনেক মানসিক টানা- পোড়েন, ঝড়ঝাপটার মধ্য দিয়ে ওদের বিয়ে হয়। মতাদা, বুড়োদা দাড়িয়ে থেবে সব কিছুর ব্যবস্থা করলেন। বিডন স্ট্রিটে ওরা প্রথম ঘর বাধে। তখনও আমরা গিয়েছি, দেখেছি তিলক-মহুয়ার সুখের সংসার। মহুয়া তখন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, অনেক সময় অনেক অনুরোধ, আবদার নিয়ে আমরা গিয়েছি, কথা রেখেছে, এতটুকু অহমিকাবোধ ওদের মধ্যে দেখিনি। কখনও কোনো অনুষ্ঠানে অতিথি- শিল্পী হয়েছে, কখনও 'ঘটকালি' নাটক করবে বলে বউবাজারের খোলা ছাদের ওপর ঘণ্টার পর ঘন্টা মহড়া দিয়েছে, মুড়ি-চানাচুর ভাগাভাগি করে খেয়েছে, নিজের পয়সা দিয়ে সিঙ্গাড়া মিষ্টি এনে খাইয়েছে। অভিনয়কে মনপ্রাণ দিয়ে ভালবেসেছে, কোনো মোহ বা উচ্চাশায় নয়, অভিনয়কে ভালবেসেই ও বড় অভিনেত্রী হয়েছে।

এরই মাঝে সুবোধের 'ঘটকালি' ছবি হয়েছে। মহুয়া তাতে নায়িকা হয়েছে। আমি একটা ছবি করেছিলাম 'চুপি চুপি', তাতে মহুয়াকে নিতে পারিনি, নিয়েছিলাম সোনালিকে। ছবির শুটিং চলাকালীন এক- দিন স্টুডিও-র মেকআপ রুমে হাসতে হাসতে বলেছিল 'কী ব্যাপার ! দমদমের লোকের ছবিতে আমিই বাদ।' ওকে কিছু বলিনি, হেসে কথাটা হজম করেছিলাম। মনের মধ্যে ইচ্ছা ছিল ভবিষ্যতে ছবি করবার সুযোগ পেলে ওকে নায়িকা করব। কিন্তু মানুষের সব আশা পূর্ণ হয় না, আমারও হল না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

টুটুন থেকে মহুয়াঃ একজন প্রতিবেশীর চোখে

  মহুয়াকে আমি চিনতাম আমাদের পাড়ার নীলুদার মেয়ে হিসাবে। সে তখন ছিল টুটুন, ভাল নাম ছিল শিপ্রা । নাচত। রেকর্ড ড্যান্স, অর্থাৎ রেকর্ড চালি তা...