মহুয়ার ডাগর-ডোগর মুখটা ক্লোজ আপে কী মিষ্টি লাগত! মহুয়ার রূপে কোনও উগ্রতা ছিল না। গায়ের রং কিন্তু শ্যামলা। মহুয়ার খুব সাধারণ মধ্যবিত্ত মানসিকতার চেহারা ছিল কিন্তু ক্যামেরার সামনে গ্ল্যামার নিয়ে আসত। এক সাক্ষাৎকারে, দেবিকা মহুয়া সম্পর্কে এই কথাগুলো বলেছিলেন
মহুয়া রায়চৌধুরীর ৪০ তম প্রয়াণ বার্ষিকীতে তাঁর কথা বললেন অভিনেত্রী দেবিকা মুখোপাধ্যায়। ৪০ বছর পর এই প্রথম মহুয়াকে নিয়ে মুখ খুললেন 'ছোট বৌ' দেবিকা।
মহুয়ার সঙ্গে দেবিকা বললেই তো মনে পড়ে 'আবির' ছবির কথা। যে ছবি মহুয়ার মৃত্যুর দু বছর পর রিলিজ করেছিল। একটু গল্প বলুন না?
আমাকে আগে কেউ কোনওদিন জিজ্ঞেসও করেননি এই বিষয়ে। অথচ মহুয়া আর আমি সহকর্মী ছিলাম এই ইন্ডাস্ট্রিতে।
'আবির' ছবির অফার নিয়ে কিন্তু পরিচালক কাজল মজুমদার মহুয়া মারা যাবার আমার কাছে এসেছিলেন। মহুয়ার সঙ্গে আমি এই ছবিতে কোনও শুটিং করিনি। কারণ ছবিটা যখন শুরু হয় আমি কোনও গল্পেই ছিলাম না। মহুয়া ছবিটা শেষ করে যেতে পারেনি। তখন ছবিটা শেষ করতে পরিচালক গল্পে আর একটি নায়িকা চরিত্র আমাকে নিয়ে এলেন। 'আবির' ছবিতে দেখা যায় আমার আর মহুয়ার একসঙ্গে দৃশ্য, বেশ কয়েকটা। কিন্তু ওগুলো সব সুচতুর এডিটিং। মহুয়া মারা যাবার পর তো ডিরেক্টর আমায় এই ছবির অফার দেন। আমি এই ছবিতে মহুয়ার সঙ্গে শুটিং করিনি। সেটা দর্শকরা ধরতে পারবেন না। 'আবির' ছবিটা ভালই চলেছিল। অল্প টাকার ছবি, আমরাও তো বেশি টাকা পাইনি সেসময়। কিন্তু চলেছিল। এই ছবিতে মাদ্রাজের একটা বিখ্যাত ট্রেনড কুকুর 'মোতি' ছিল। সে হিন্দি সিনেমাও অনেক করেছিল। যাকে দেখেতেও 'আবির' ছবিটা জনপ্রিয় হয়েছিল।
মহুয়ার সঙ্গে আর কোনও ছবিতে আপনি কাজ করেছিলেন?
হ্যাঁ তপন সিনহার 'রাজা'। একই ছবিতে আমরা দু'জন ছিলাম। তপন সিনহার সঙ্গে কাজ করা আমার কাছে একটা স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। তার আগে 'বাঞ্ছারামের বাগান', 'আদালত ও একটি মেয়ে' করেছি। তবে তপনদার আর একটা ছবিতে আমি হিরোইন ছিলাম। যে রোলটা হিন্দিতে মহুয়া করেছিল। 'আদমি অউর অউরাত' ছবিতে অমল পালেকর আর মহুয়া রায়চৌধুরী ছিল। এই হিন্দি ছবিটার গল্প নিয়ে একটা বাংলা ছবিও হয়েছিল 'মানুষ'। মহুয়ার রোলটা আমি করি আর আমার বিপরীতে ছিলেন শমিত ভঞ্জ। মহুয়া মারা যাবার পর এই বাংলা 'মানুষ' ছবির আমার কাছে আসে। এই ছবিটা মুক্তিও পেয়েছিল পরে। কিন্তু এখন আর কোনও চর্চায় নেই। আমাকে শুধুই 'ছোট বৌ' বলা হয় চিরকাল। অথচ তপন সিনহার এতগুলো ছবি করেছি। 'মানুষ' ছবিতে হিরোইন আমি, তবু কজন আর জানল? ছবিটাই তো পাওয়া যায় না।
মহুয়া আমার থেকে একটু সিনিয়র ছিল। তবে আমার দু'জন দু'জনকে তুই করেই বলতাম। ওঁর চলে যাওয়া বড় মাপের নায়িকার প্রস্থান। ভীষণ ইমোশনাল অ্যাকট্রেস ছিল মহুয়া। গ্লিসারিন ছাড়া কাঁদতে পারত। যেটা এখন কেউ জানেই না, পারেই না। সব চোখে ড্রপ দিয়ে দিয়ে কাঁদে। নিজের বাস্তব জীবনের কষ্টটা মহুয়ার মনে পড়ত। তাই বলত 'কান্নার সিনে আমার গ্লিসারিন লাগে না'। একটা মেয়ে যখন ক্যামেরার সামনে হাউহাউ করে কাঁদতে পারে তখন তো তাঁর ভেতরের যন্ত্রনাগুলো বেরিয়ে আসে। আমিও পারতাম সেটা।আমি মহুয়াকে বলতাম 'আমার ছোটবেলায় বাবা মারা গেছে, বাবার কথা ভেবে আমি কেঁদে ফেলি'। মহুয়াও তখন বলত 'আমার জীবনেও অনেক কষ্ট আছে। সেগুলোর কথা ভেবে আমি কেঁদে ফেলি'।
ওঁর মৃত্যুর ৪০ বছর পরও অমন অভিনেত্রী আর পাওয়া যাবে না। মহুয়ার ডাগর-ডোগর মুখটা ক্লোজ আপে কী মিষ্টি লাগত! মহুয়ার রূপে কোনও উগ্রতা ছিল না। গায়ের রং কিন্তু শ্যামলা। মহুয়ার খুব সাধারণ মধ্যবিত্ত মানসিকতার চেহারা ছিল কিন্তু ক্যামেরার সামনে গ্ল্যামার নিয়ে আসত। ক্যামেরাতে ভীষণ ( ভীষণে জোর দিলেন দেবিকা) ভাল আসত। কিন্তু খুব ঘর-গেরস্থর মেয়ে ছিল। ওঁকে সামনে দেখলে কেউ বলবে না সিনেমা আর্টিস্ট। একটু ক্ষ্যাপাও ছিল। বাইরে কোথাও রাতে শো করে এসে, স্টুডিওর বাথরুমে স্নান করে নিল। আমি বললাম, 'বাড়ি যাবি না?' বলল 'দূর বাড়ি গিয়ে আবার স্নান কে করে!' স্টুডিওটাকেই মহুয়া ওঁর ঘর সংসার ভেবে ফেলত।
আমরা সহকর্মী ছিলাম। আমার সঙ্গে ওঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল না। রত্না দির (ঘোষাল) যেটা ছিল। কাজ করতে গিয়ে টুকটাক ব্যক্তিগত কথা যা হত। একবার টেকনিশিয়ান স্টুডিওর মেকআপ রুমের ভিতর ঢুকে দেখলাম মহুয়া মেকআপ করছে। আমিও মেকআপে বসব। ওঁর আর আমার আলাদা ছবি ছিল। কিন্তু আমরা এক মেকআপ রুম শেয়ার করছিলাম। তখন দেখি মহুয়ার মুখে মারের দাগ। ঠোঁটের কাছে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। মুখ মার খেয়ে ফুলে রয়েছে। কাটার দাগ। মেকআপ ম্যানকে মুখের দাগগুলো ঢেকে দিতে বলছিল মহুয়া। তখন মহুয়াকে বললাম 'এই অবস্থা তোর কে করল?' বলল 'তিলক, আমার বর!' আমি বললাম তোদের এত ঝগড়া, মারপিট হয় কেন? এত মার খাবি কেন? তখন বলল 'আমি একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছিলাম। সারাক্ষণ টাকা চায়। তাই মারপিট হয়ে যায়।' এটা তো আমি একদিনের ঘটনা বলছি, যা দেখেছিলাম। কিন্তু স্টুডিওপাড়ায় শুনতাম লোকমুখে ওঁরা স্বামী-স্ত্রী দু'জন হামেশাই মারপিট করত। আসলে বেশি জিজ্ঞেস করিনি। আমার তখন অত ম্যাচিউরিটি ছিল না। মহুয়ারও ছিল না। ব্যক্তিগত সংসার জীবন আর প্রফেশনাল জীবন এক করে ফেলত। আমি তাও ওঁকে বুঝিয়েছিলাম। কিন্তু আমার জ্ঞান সেদিন মহুয়া শোনেনি। সংসারে শান্তিটা ওঁর ছিল না। সেটা আমি ওকে দোষ দেব না। ওঁর স্বামীকেও চিনতাম না। আমি বলব আমি জানিনা। যা দেখেছিলাম সেটা খুব কষ্টের। কিন্তু আমি সবসময় ওঁর ভালটা তুলে ধরব। আমি নিজে একজন অভিনেত্রী হয়ে ওঁকে গুণী অভিনেত্রী হিসেবেই দেখব।
আমি তো গিয়েছিলাম তখন মহুয়ার এস এন রায় রোডের বাড়িতে। আমাদের ফিল্মের লোকজন অনেকেই ছিলেন। কিন্তু মহুয়ার মুখ তো ঢাকা ছিল। আগুনে পোড়া শরীর সম্পূর্ণ কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। শবদেহটা দেখেছিলাম কিন্তু আমি তো মহুয়ার মুখ দেখতে পাইনি। সেখানে ওঁর বর, বাবা, ছেলে গোলা সবাইই ছিল। কী ভাবে আগুন লাগল আমি জানিনা। শুনেছিলাম সুইসাইড বা এতটাই অতিরিক্ত মদ্যপান করেছিল যে ছেলের দুধ গরম করতে গিয়ে কখন আগুন লেগে গিয়েছে গায়ে নিজেই বুঝতে পারেনি। ওরকম মৃতদেহর সামনে কী আর এত প্রশ্ন করা যায়! আমি কিছু জিজ্ঞেস করিনি। আমি ভাবতেই পারছিলাম না। ভগবান যাকে যখন নিয়ে নেন। ওঁর মতো অভিনেত্রী আর এল না ইন্ডাস্ট্রিতে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন