আমার বাবা নীলাঞ্জন রায়চৌধুরী। অভিনয়ের প্রতি তার একটা অনুরাগ ছিলই, ফিল্মের কাজকর্মের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। তিনি তাঁর নিজের জীবনে যে স্বপ্ন দেখতেন তার অনেকটাই পূরণ করতে চেয়েছিলেন আমার মধ্য দিয়ে। আর তাছাড়া বলতে কি, আমাদের সংসারের অবস্থা তখন খুব একটা ভাল ছিল না। হয়ত ভেবেছিলেন আমি সিনেমায় চান্স পেয়ে গেলে তার আর্থিক দিকেরও কিছু সুরাহা হবে। আমি তখন নাচ শিখতাম—ইচ্ছে ছিল নৃত্যশিল্পী হব। সেটা আর হল না। ফিল্মসেন্স তো দূরে থাক, আমার যখন অভিনয় সম্পর্কেই বিশেষ কিছু আগ্রহ জন্মায়নি, বাবা তখন থেকেই আমাকে সিনেমার নামাবার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। বলা বাহুল্য সেই সময়েই মেয়ের জনে। তাঁকে কিছু গল্পনা-লাঞ্ছনা সইতে হয়েছিল। ছেলেমানুষ হলেও সেটা বোঝার মত বয়েস আমার ছিল। যেমন ধরুন, বাবা আগেভাগে কথা বলেই কোনো পরিচালকের কাছে আমাকে নিয়ে গিয়েছেন-তো তিনি আমাকে দেখে একেবারেই বিরূপ আশাহত মন্তব্য করে বসলেন- এই আপনার ে কি হবে একে দিয়ে ভাল করে লেখাপড়া শেখান বিয়েথা দিন ইত্যাদি ।
বাবা আমার কাছে ধরা দিতে না চাইলেও লক্ষ্য করতাম প্রায় ধিকার প্ররূপ। । এইসব মন্তব্য শুনে বাবার মুখ শুকিয়ে যেত। তার কিছু নয়, সেটা দেখে আমার আত্মসম্মানে য লাগত। বাবাকে বলতাম- হ্যাঁ গো তুমি কি? আমাকে এইভাবে লোকের কাছে নিয়ে যাও, তারা আমার সঙ্গে তোমাকেও অপমান করে। চল বাড়ি চল, আমার কোনো দরকার নেই সিনেমা করবার।
কতদিন এমন হয়েছে, প্রায় কান্না এসে গেছে চোখে। বাবা কিন্তু দমতেন না, বরং আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে হাসতে হাসতে বলতেন—দূর কে কি বলল তাতেই এত চটে যেতে হয় নাকি তোর আবার এইটুকু বয়েসেই বেশি প্রেস্টিগমন। হয়ত সেটা ছিল, তাই ছোটবেলায় আমাকে সবাই ডাকত 'প্রেস্টিজ কুকার' বলে। বাবাও এই বলে খ্যাপাতেন তখন । আর বলতেন-কে তোকে ফিরিয়ে | দিল তাতেই তোর কিছু হবে না এটা ধরে আসলে তার নিজের মনের জেদটাকেই ফিরিয়ে আনার জানো। আর সেটা শেষ পর্যন্ত ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন বলেই তো এই আজকের আমি জানবেন, পারিবারিক দিক থেকে এই আমি সম্পূর্ণই আমার বাবার। তার স্বপ্ন কতটা সার্থক করতে পেরেছি জানি না, তবে নিশ্চয়ই কিছুটা পেরেছি। এটা ভেবে আমার আনন্দ হয়, অন্যদিকে কখনও-সখনও একটু মন খারাপ হয় বইকি, যখন ভাবি আমার মা। মাধবীলতা রায়চৌধুরী কিন্তু আমাকে একেবারেই অন্যভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। আমাকে ঘিরে আমার মা-বাবার স্বপ্ন ছিল একেবারেই বিপরীতমুখী।
মা নিজে যথেষ্ট শিক্ষিতা, মহিলা হয়েও অনির্ভর, এখনও চাকরি করেন। তিনি চেয়েছিলেন আমি মন দিয়ে লেখাপড়া করি। আমার ফিল্ম লাইনে আসাটা আদৌ পছন্দ ছিল না তার। অনেকেই জানেন না, আমি খুব ছোট বয়েসে দুটি হিন্দি ছবিতে নেমেছিলাম—সেসব 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ'-এরও আগে। এই ছবি দুটিতে আমার নাম দেওয়া হয়েছিল বেবি সোনালি আসলে আমার নাম শিপ্রা। মেয়ের নাম সিনেমায় ব্যবহার হবে, মা এটা চাননি। আমার 'মহুয়া' নামটা তো আমার আরেক জন্মদাতার, আপনারা জানেন স্টুডিয়োর লোকজনদের কাছে, যিনি "তনুবাবু' নামে পরিচিত অর্থাৎ তরুণ মজুমদারের দেওয়া। কোন দূরদর্শিতায় জানি না, উনিই তো প্রথম আমার সম্ভাবনার কথা টের পেয়েছিলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন