শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ মুক্তির বছরখানেক পর মহুয়া রায়চৌধুরীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার

 বাংলা ছবির সেই সময়কার অন্যতম জনপ্রিয় নায়িকা ছিলেন তিনি। তাঁর নামে প্রেক্ষাগৃহ হাউজ়ফুল হতো। প্রথম ছবি ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ মুক্তির বছরখানেক পর মহুয়া রায়চৌধুরীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন নির্মল ধর।



নির্মল ধর: ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ ছবিতে যখন অভিনয় করেন, তখন আপনার বয়স কত?

মহুয়া: তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। বয়স আর কত হবে? আটান্ন সালে জন্ম। (জন্ম তারিখ জিজ্ঞাসা করায় পাশে বসা বাবা বললেন ছাপান্ন সাল। মা বললেন, না আটান্ন) আসলে বয়স বাড়িয়ে বা লুকিয়ে বলার কারণ কি জানেন? আমাকে সকলেই খুব বেশি বয়সী বলে ভেবে নেয়। আমার এখন সতেরো চলছে। কালকেই (২৬ সেপ্টেম্বর) জন্মদিন গেল।

প্রশ্ন: ফিল্মে কাজ করতে এসে পড়াশুনোর ক্ষতি হচ্ছে না?

মহুয়া: অসুবিধা তেমন কিছু হচ্ছে না। কাজের চাপে স্কুল ছেড়ে দিতে হয়েছে, এই আর কী! বাড়িতে টিউটরের কাছে নিয়মিত পড়ছি। সেভেনটি ফাইভে স্কুল ফাইনাল দেব। স্টুডিয়োয় যখন কাজ করি, কাজই করি। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। অসুবিধে কী হবে?

প্রশ্ন: ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এর শেষে আপনার এবং অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা চুম্বন দৃশ্য ছিল। সেটা সাজেশনে দেখিয়েছেন পরিচালক তরুণ মজুমদার। ওই দৃশ্যে অভিনয়ের আগে তরুণবাবু আপনাকে কীভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন?

মহুয়া: সত্যি কথা বলতে কী তরুণবাবু আমার কাছে কিছুই লুকোননি। পায়ের ওপর পা দিয়ে দাঁড়ালে দৃশ্যটার যে কী মিনিং হবে তা আমাকে বলে দিয়েছিলেন। আমারও খুব একটা অসুবিধা হয়নি। কারণ, এটা তো ঠিক, আগেকার দিনের ওই বয়সের মেয়ের চাইতে আজকালকার মেয়েরা অনেক বেশি জানে এবং বোঝে। প্রথমটায় একটু দ্বিধা-লজ্জা নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু আনন্দও কম ছিল না।

প্রশ্ন: বাংলা ছবিতে তাহলে চুম্বন দৃশ্য আসুক আপনি চান?

মহুয়া: হ্যাঁ, চাইব না কেন? তবে সুন্দরভাবে আসুক, অশ্লীলভাবে নয়। ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এই যেমন সিম্বল দিয়ে দেখানো হয়েছে, তেমন করেই হোক। ক্ষতি কি? ফেস-টু-ফেস কিসিং দেখাতেই হবে এমন তো কথা নেই! শৈল্পিক ভঙ্গিতে দেখানো চুম্বন দৃশ্য খারাপ লাগবে না।

প্রশ্ন: তরুণ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ফিল্ম ইনস্টিটিউট বা ওই জাতীয় কোনও প্রতিষ্ঠান থেকে ফর্মাল ট্রেনিং থাকা কি অবশ্য দরকার?

মহুয়া: না, মোটেই না। আগেকার সব বিখ্যাত শিল্পীরা প্রায় কেউই কোনও ট্রেনিং পাননি। তাঁরা অভিনয় শিখেছেন কি করে? আসলে দরকার অভিনয়-ক্ষমতা। ওই জিনিসটা থাকলেই চলবে। না হলে সবই ফক্কা। প্রতিবছর তো পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে গুচ্ছের ছেলেমেয়ে পাশ করছে। বলুন তো, তাদের মধ্যে সবাই কি দাঁড়াতে পারছে? তবে হ্যাঁ, একটা তকমা থাকলে চান্স পাওয়া যায় মাঝেমধ্যে।

প্রশ্ন: অভিনয় সম্পর্কে থিয়োরিটিকাল বা প্র্যাকটিকাল কোনও অভিজ্ঞতারই প্রয়োজন নেই, আপনি এ কথাই বলতে চান?

মহুয়া: হ্যাঁ, মোটামুটি তাই বলতে চাই। পড়াশুনো করে যেটুকু জানার সেটা না জানলে খুব একটা ক্ষতি আছে কি? বরং অভিনয়ের প্র্যাকটিস করতে পারলে কাজ হয়।

প্রশ্ন: স্কুলে নিশ্চয়ই ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য কী’ বা ওই জাতীয় কোনও রচনা লিখেছেন। কী লিখেছিলেন তখন?

মহুয়া: ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছি স্কুলে। নাইনে উঠে ছেড়ে দিয়েছি। ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য’ নামে কোনও রচনা সৌভাগ্যক্রমে আমাকে লিখতে হয়নি। তবে ছোটবেলায় ভয়ানক ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হব। ডাক্তারদের বেশ থ্রিলিং লাইফ, তাই না?

প্রশ্ন: ডাক্তার তো হতে পারলেন না। আপশোস হচ্ছে না?

মহুয়া: হচ্ছে তো বটেই। কিন্তু এখন তো আর ডাক্তার হতে পারব না। ফিল্ম লাইনে চলে এসেছি। জেনারেল পড়াশুনাই চালাতে হচ্ছে প্রচণ্ড খেটে। তার ওপর আবার ডাক্তারি! হবে না। তবে কী জানেন, আমি অঙ্কে আর বিজ্ঞানে খুব ভালো ছিলাম। অঙ্কে আটের ঘরে আর বিজ্ঞানে ছয়ের ঘরের নীচে কোনওদিন নম্বর পাইনি। কিন্তু কী আর হবে! ভাগ্য সব পাল্টে দিচ্ছে!

প্রশ্ন: ফিল্মে অভিনয় করার ব্যাপারে বাড়ির কারওর  অমত ছিল? বা এখনও আছে কি?

মহুয়া: তেমন জোরাল কোনও অমত কারওর ছিল না। বলতে গেলে বাবার আপ্রাণ চেষ্টাতেই আজ আমি ফিল্মে চান্স পেয়েছি এবং পাচ্ছি। প্রথমটায় মায়ের একটু অমত ছিল। মৃদু আপত্তিও জানিয়েছিলেন। এখন অল কোয়ায়েট ইন দ্য হোম ফ্রন্ট বলতে পারেন।

প্রশ্ন: অভিনয়ের প্রতি আপনার আকর্ষণ এল কীভাবে বা কার কাছ থেকে?

মহুয়া: ছোটবেলায় পাড়ায় বিভিন্ন ফাংশনে নাচতাম। স্কুলেও নাটক করেছি দু’-একটা। বাবা আমার এই নাচের ব্যাপারটাকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আমাকে ফিল্মে নামাবার জন্য তিনিই বহুদিন ধরে বহু লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন। তাঁর চেষ্টা আজ সফল হতে চলেছে, এটাই আমার আনন্দের বিষয়।

প্রশ্ন: যদিও বেশিদিন কাজ করছেন না, তবুও এই অল্প ক’দিনে ফিল্ম লাইন সম্পর্কে আপনার কী ধারণা হয়েছে যদি অল্পকথায় বলেন?

মহুয়া: ফিল্ম লাইন সম্পর্কে বাইরের লোক হিসেবে খুব একটা পরিষ্কার ধারণা আমার ছিল না। এখনও যে ধারণাটা খুব স্পষ্ট, তা বলতে পারছি না। তবে এ লাইনে ভালো লোক যেমন আছেন, খারাপ লোকেরও অভাব নেই। খুব সাবধানে চলতে হচ্ছে। অনেকেই কথা দিয়ে কথা রাখেন না। এটাই খারাপ লাগে। এই তো কিছুদিন আগে একজন পরিচালক তাঁর ছবির জন্য আমাকে ঠিক করলেন। ক’দিন রিহার্সালও দিলাম। তারপর হঠাৎ কাগজে দেখলাম শিল্পী তালিকায় আমার নাম নেই। তা নিয়ে আমি কোনওদিন অভিযোগ করিনি কারওর কাছে। সেই পরিচালককেও কিছু বলিনি। আমার রিঅ্যাকশন তাঁকে বুঝতেই দিইনি। যা আছে আমার মনের মধ্যেই আছে। বরং একদিন রাস্তায় সেই পরিচালককে হন্যে হয়ে ট্যাক্সি খুঁজতে দেখে আমার গাড়িতে লিফট দিয়েছি। উনি সেদিন গাড়িতে বসে আমাকে বলেছিলেন, ‘মহুয়া, তোমাকে নিলেই বোধহয় ভালো হত। ছবিটা রিলিজ় করে যেত এতদিনে।’ এই ধরনের কথা দিয়ে কথা না রাখা ব্যাপারটা বড় খারাপ লাগে।

প্রশ্ন: ফিল্মের কোনও হিরো আপনাকে প্রেম নিবেদন করেছে এখনও পর্যন্ত?

মহুয়া: হ্যাঁ, সেরকম প্রস্তাব পেয়েছি। কিন্তু নামটা আমি বলতে পারব না। কাইন্ডলি অনুরোধ করবেন না।

প্রশ্ন: আপনার রিঅ্যাকশন কীরকম?

মহুয়া: ফিল্ম হিরোদের প্রেম সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই। এদের বেশিরভাগেরই চোখে একটা রঙিন চশমা আঁটা থাকে। আজ এই হিরোইনকে ভালো লাগে, কাল আমাকে, পরশু অন্য কাউকে। আসলে এদের চাহিদাটা একটা জায়গাতেই সীমাবদ্ধ। ফিল্ম হিরোর সঙ্গে প্রেম আমি ভাবতেই পারি না।

প্রশ্ন: তাহলে আপনার প্রেমের লাইফ ফিল্ম লাইনের বাইরেই থাকছে?

মহুয়া: হ্যাঁ, তাই।

প্রশ্ন: ফিল্ম লাইনের বাইরে কেউ আপনাকে প্রেম নিবেদন করেছে কি?

মহুয়া: আপাতত তেমন কেউ নেই। থাকলেও বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা একান্তই ব্যক্তিগত এবং গোপনীয়। এর চাইতে বেশি আর কিছু বলতে পারব না।

প্রশ্ন: বাড়িতে আপনার বাবা-মা কি আপনাকে ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছেন?

মহুয়া: এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলি। আমার বাবা-মা কেউই তেমন অতিআধুনিক মাইন্ডেড নন। কিছু সংস্কার তাঁদের মধ্যে আছেই। তবুও আমার জীবনের কোনও ডিসিশন নেওয়ার আমার যেমন অধিকার আছে, বাবা-মায়ের মতকেও একেবারে উড়িয়ে দিতে পারব না। কিছু করার আগে একটু ভাবব। তবে কী না সবকিছুই সময়ের ওপর নির্ভর করে।

প্রশ্ন: উত্তমকুমার সম্পর্কে আপনার নিশ্চয়ই একটু বেশিই ঔৎসুক্য ছিল। এখন তো তাঁর সঙ্গে অভিনয় করছেন। ভাবতে কেমন লাগছে?

মহুয়া: সত্যি কথা বলতে কী, উত্তমকুমার বলতে মেয়েরা যেমন পাগল হয়ে যায়, আমি তেমন কোনওদিনই ছিলাম না। আমাদের পাড়ায় বহু ছবির শুটিং হয়েছে। পাড়ার সবাই ঝেঁটিয়ে গিয়েছে উত্তমকুমারকে দেখতে। মেয়েদের মধ্যে সে কী উত্তেজনা! আমি কিন্তু তেমন উৎসাহ পেতাম না। এখন তাঁর সঙ্গে অভিনয় করছি। ভাবলে আনন্দ লাগে অবশ্যই। ওঁর সঙ্গে কাজ করে আমি শিখছিও অনেক কিছু।


প্রশ্ন: কথায়-কথায় আসল ব্যাপারটা জানা হল না। ফিল্ম লাইনে আগে থেকে তো আপনার জানাশোনা কেউ ছিল না। তাহলে সুযোগ পেলেন কীভাবে?

মহুয়া: কোথা থেকে শুরু করব তাই ভাবছি। ঘটনা তো অনেক। ‘নয়া মিছিল’ ছবির একটা চরিত্রের জন্য মেক-আপ টেস্ট দিতে গিয়েছিলাম। পরিচালক পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়ের পছন্দ হল না। তখন মেক-আপম্যান জামাল সাহেব আমাকে তরুণবাবুর কাছে পাঠালেন। গেলাম। উনি দেখে-টেকে বললেন, ‘খবর দেব।’ এর আগেই অবশ্য গায়িকা বনশ্রী সেনগুপ্ত আমার একখানা ছবি তরুণবাবুকে দিয়েছিলেন। খবর পেলাম তরুণবাবু আমাকেই সিলেক্ট করেছেন। অবশ্য এতসব যোগাযোগের পিছনে বাবার আপ্রাণ পরিশ্রমটাই কাজ করেছে বেশি।

প্রশ্ন: আপনার সমসাময়িক নতুন নায়িকাদের সঙ্গে আপনি কোনও প্রতিযোগিতার ভাব বুঝতে পারছেন কি?

মহুয়া: না, তেমন কিছু আমি ফিল করিনি এখনও। আমার বয়স তো খুবই অল্প আর যাঁরা আছেন তাঁদের সঙ্গে এখনও আমার কম্পিটিশনের ব্যাপারটা আসেনি। যে ধরনের চরিত্র আমি করছি, সেখানে আমার বয়সি শিল্পীই বা কোথায়? অনেকেই আমার চাইতে বয়সে ও অভিজ্ঞতায় বড়।

প্রশ্ন: আপনার সাফল্য-ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?

মহুয়া: ছবিতে কাজ করছি, সবাই ভালো বলছেন। এটাই ভালো লাগছে। তবে আমি নিজে সন্তুষ্ট নই। বেশি আর কী বলতে পারি!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ মুক্তির বছরখানেক পর মহুয়া রায়চৌধুরীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার

 বাংলা ছবির সেই সময়কার অন্যতম জনপ্রিয় নায়িকা ছিলেন তিনি। তাঁর নামে প্রেক্ষাগৃহ হাউজ়ফুল হতো। প্রথম ছবি ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ মুক্তির বছরখানেক ...