একজন অভিনেত্রী হিসেবে মহুয়া রায়চৌধুরী সম্পর্কে সত্যজিৎ রায়ের মূল্যায়ন


'আপনার মতে বাংলার সেরা অভিনেত্রী কে তৈরি করেছেন?' একজন প্রভাবশালী সাংবাদিক বন্ধুর প্রশ্নের জবাবে সত্যজিৎ রায় এক মুহূর্ত দ্বিধা ছাড়াই বলেছিলেন: 'সাবিত্রী চ্যাটার্জি।' সুচিত্রা সেন নন, সুপ্রিয়া দেবী নন, মাধবী মুখার্জি নন (সত্যজিৎ রায়ের তিনটি ছবির নায়িকা)। তারপরে, কিছুক্ষণ বিরতির পরে, তিনি যোগ করেছেন: 'একমাত্র অন্য অভিনেত্রী যিনি সাবিত্রী চ্যাটার্জির কাছাকাছি ছিলেন তিনি হলেন মহুয়া রায় চৌধুরী।'

এটা বিবেচনা করা উচিত যে মহুয়া মাত্র 27 বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন এবং সেই সময় সত্যজিৎ রায় মহুয়াকে মূল্যায়ন করেছিলেন। মহুয়া রায়চৌধুরী বেঁচে থাকলে মহুয়া কোন উচ্চতায় পৌঁছে যেত কেউ জানে না।

সত্যজিৎ রায় মহুয়াকে একজন ভালো অভিনেত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং বিশ্বখ্যাত পরিচালক অবশ্যই মহুয়াকে তাঁর ছবিতে সুযোগ দিতেন।


সত্যজিৎ রায় 'আদমি ঔর আউরত' ছবিতে মহুয়া রায়চৌধুরীর কাজ প্রসঙ্গে বলেন, 'ছবিতে মহুয়া ভালো কাজ করেছে'

মহুয়া রায়চৌধুরীর চোখে উত্তম কুমার

 মহুয়া উত্তম কুমারের সাথে অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন এবং বাঘ বন্দি খেলা তার মধ্যে একটি। এই ছবির একটি বিশেষ দৃশ্য নিয়ে মহুয়ার বক্তব্য।


উত্তমকুমারকে নিয়ে সেরকম উন্মাদনা আমার ছিল না, যতটা আমার বন্ধুদের মধ্যে ছিল । এটা তাই জন্যই বলছি কারণ ওরা উত্তমকুমারকে ওদের স্বপ্নে দেখা রাজপুত্র মনে করতো । হ্যাঁ, ওঁর ছবি নিশ্চই আমার ভালো লাগতো কিন্তু ওদের মতন এতটা বাড়াবাড়ি আমি করতে পারিনি । তবে আমার যেটা ওঁর প্রতি ছিল সেটা হলো শ্রদ্ধা, পরে যখন ওঁর সাথে কাজ করা শুরু করলাম এই শ্রদ্ধা আরও দ্বিগুণ হয়েছিল । এখনও 'বাঘ বন্দী খেলা'এর শুটিংয়ের দৃশ্যখানা ভুলতে পারবো না । ওই ছবিতে যিনি আমার বাবার চরিত্রে ছিলেন তাঁর সাথে উত্তমকুমারের একটি শট ছিল, যদিও আমি সেই শটটায় ছিলাম কিন্তু কমিউনিকেশন হবে শুধু ওদের মধ্যেই । আমার কাজটা শুধু এক্সপ্রেশনের, সংলাপ প্রায় নেই বললেই চলে । ভবেশ ব্যানার্জির দ্বারা আমাদের প্রতারিত হওয়ার দৃশ্যটা ক্যামেরায় তোলা হবে । শট শুরুর আগে আমি উত্তমকুমারকে বললাম "আমাকে তো বলা হচ্ছে ফেসের মধ্যে যাতে ঘৃণা এবং বিরক্তিসূচক এক্সপ্রেশনটা নিয়ে আসি অমুক সংলাপটা চলাকালীন ।" তখন উত্তমকুমার ওঁর হাতে ধরা স্ক্রিপ্টটার দিকে তাকিয়েই বললেন "বেশ তো, তাই করিস ।" আমি আবারও বললাম "কিন্তু সত্যি সত্যি তো দূরের কথা, মিথ্যে অভিনয় করলেও আপনাকে দেখে আমার এইধরণের এক্সপ্রেশন বেরোবে না । এবং যদি ঘৃণা ফোটানোর চেষ্টাও করি সেটা একদমই ন্যাচারাল দেখাবে না ।" এবার কিন্তু উত্তমকুমার আমার দিকে তাকালেন, বোধহয় ছবিতে আমার যে চরিত্রটি ছিল সেটার প্রতি আমার এমন ইনভলভমেন্ট দেখে উনি খুশিই হয়েছিলেন । আমার দিকে তাকিয়েই উনি বললেন "তখন তোর সামনে উত্তমকুমার না, ভবেশ বাড়ুজ্যে থাকবে । এই ভবেশ লোকটা খুব খারাপ জানিস তো । সবাই তাকে ভয় পায়, ঘৃণা করে ।" ব্যাস আর কিছু বললেন না, আমিও আর কথা বাড়ালাম না । তারপর শটটা যখন টেক হল কেন জানি না আমার মনে হলো গোটা ছবি জুড়ে আমার সেরা অভিনয়টা বোধহয় ওখানেই ছিল । ভবেশ ব্যানার্জির ওই নিষ্ঠুরতায় ভরা শঠতা দেখে খুব ন্যাচারালিই আমার এক্সপ্রেশনটা চলে এসেছিল । এবং পরিচালক যেটা আশা করেছিলেন তার থেকেও আমি ভালোভাবে উতরে দিয়েছি । শটটা শেষ হতেই উত্তমকুমার আমায় রসিকতা করে বলেছিলেন "ভবেশ বাড়ুজ্যে লোকটা খুব খারাপ তাই না রে, এই মিষ্টি সরলমনের মেয়েটার মনে কত দুঃখ দিলো বল তো ।" আমারও কি জানি তখন কি একটা মনে হলো ওঁর পায়ে হাত দিয়ে একটা প্রণাম করে বসলাম ।

মহুয়ার ৬৬তম জন্মদিন




মহুয়ার আরেকটি জন্মদিন এবং বাংলার মানুষ এখনও তাদের মিষ্টি অভিনেত্রীকে মনে রেখেছে।




২৪শে সেপ্টেম্বর মহুয়া রায়চৌধুরীর জন্মদিন এবং ১৯৫৮ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। 

মহুয়া মাত্র 27 বছর বেঁচে ছিলেন এবং 1985 সালের 22 জুলাই মহুয়া পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। তার মৃত্যু দুর্ঘটনা নাকি আত্মহত্যা নাকি হত্যা তা এখনও রহস্য।


 

মহুয়া ভালো গল্পের ছবিতে অভিনয় করতে চেয়েছিলেন

 বলা হয়েছিল যে মহুয়া অনেক দুর্বল চিত্রনাট্য এবং নির্দেশিত ছবিতে অভিনয় করেছিলেন যেগুলি তিনি প্রচুর প্রতিভার সাথে আপস করেছিলেন। মহুয়া রায়চৌধুরী প্রচুর প্রতিভাবান ছিলেন কিন্তু তার সময়ের অনেক ভালো পরিচালক তাকে তাদের ছবিতে কাস্ট করেননি। এ নিয়ে মহুয়ার একটা দুঃখ ছিল।




মহুয়া রায়চৌধুরীর মৃত্যু নিয়ে কিছু রহস্য

 ৩ জুলাই-এর পর বাংলাদেশ চলে যাওয়ার কথা। মমতাজ আলমের ‘ঊশীলা’ ছবির নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করবার আয়োজন সম্পূর্ণ। অপেক্ষা শুধু ভিসা পাওয়ার।




সংশয় সন্দেহ আজও
মৃত্যুকালীন জবানবন্দি নেন এনসি বন্দ্যোপাধ্যায়, ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেণ্ট পুলিশ, সিআইডি এবং এএন দুবে, ইন্সপেক্টর।
সাক্ষী হিসেবে সই করেন দাদা পিনাকী রায়চৌধুরী এবং সিস্টার ঊষা। উপস্থিত ছিলেন রত্না ঘোষাল।
বহু সংশয়ের নিষ্পত্তি আজও হয় নি। সেই সময়কার সংবাদমাধ্যমে ধরা আছে অগুনতি পরস্পরবিরোধী তথ্য।—
•মাঝরাত অতিক্রান্ত।
বাড়িতে দু’জন পরিচারক। তবু মহুয়া নিজে খাবার বা দুধ গরম করতে গেল কেন?
•তিলক কিন্তু ডিনারের পরেই দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছিল। মহুয়ার কথামতো তার অসাবধানতাবশত যদি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে বাড়িতে চারজন মানুষের উপস্থিতি সত্ত্বেও কী করে এমন ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছিল?
•স্টোভ বার্স্টের একটা তত্ত্ব পরিবারের তরফ থেকে বার বার খাড়া করা হয়েছে। পুলিশ অত্যন্ত কম কেরোসিন ভরা একটি স্টোভ রান্নাঘর থেকে প্রায় অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে, যেটা কোনও ভাবে কোনও দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে বলে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি।
•পিঠে এবং শরীরের আরও কয়েক জায়গায় কালশিটের দাগ পাওয়া যায় যার কোনও সদুত্তর মেলেনি।
•মহুয়ার মুখের ডান দিকে একটা ক্ষতচিহ্নের বিচিত্র ব্যাখ্যা মেলে বাবার কাছে।— কোনও কাপড়ের টুকরো আটকে যায় দুর্ঘটনার সময়, যেটা টেনে তুলতে গেলে মহুয়া ব্লেড দিয়ে কেটে নিতে বলে আর তাতেই নাকি এই বিপত্তি।
প্রায় সত্তরভাগ অগ্নিদগ্ধ মানুষের পক্ষে এ কি সম্ভব?
•রান্নঘর এক রকম অক্ষত। অথচ শোবার ঘরে লেপ তোষক মায় বালিশ পর্যন্ত পোড়া।
নাইটি এবং বিছানায় এত কেরোসিনের গন্ধ কোথা থেকে এসেছিল?
স্টোভ বার্স্ট করলে পিঠ, তলপেট, ঊরু এমন ভয়াবহ দগ্ধ কেন?
•নীলাঞ্জনের মাত্র তিনটি আঙুলের ডগায় সামান্য চোট ছিল। তিলক অক্ষত। শুধুমাত্র খুঁড়িয়ে হাঁটছিল।
অনেকেই মনে করেছিলেন, অমন মারাত্মক আগুন থেকে বাঁচাতে গেলে এ এক রকম অসম্ভব।
•পরিবারের তরফ থেকে কোনও এফআইআর করা হয়নি। শোনা যায়, তদন্ত চলার কিছুদিনের মধ্যে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তা বন্ধের নির্দেশ আসে!
কিন্তু কেন?
আজও জানা নেই তা’ও।
চূড়ান্ত অভিযোগ
ব্যক্তিগত ভাবে মাধবী চক্রবর্তী জানান মহুয়ার মৃত্যুর অনতিকাল পরে তার বাবা স্মরণসভা আয়োজন করবার প্রস্তাব নিয়ে তাঁর কাছে আসেন।
মৃত্যুর যথোচিত কারণ না জানা পর্যন্ত এ ধরনের কোনও সভায় তিনি অংশগ্রহণ করবেন না বলে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন মাধবী চক্রবর্তী
দশ বছর পর প্রদেশ মহিলা কংগ্রেস আয়োজিত আন্তর্জাতিক নারীদিবস উপলক্ষে মাধবী চক্রবর্তী তাঁর ভাষণে মহুয়া রায়চৌধুরীকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ তোলেন।

আরেকটি নিষ্ঠুর 22 জুলাই - 2023

আরেকটি নিষ্ঠুর 22 জুলাই। মহুয়া তার হৃদয়ের গভীরে অনেক কষ্ট নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। অনেক কষ্ট যা মহিলার জন্য খুব বেশি ছিল এবং তাও সেই বয়সে যখন সাধারণত মহিলারা বিয়ে করে।




মহুয়া রায়চৌধুরী মারা যাওয়ার 38 বছর পেরিয়ে গেছে আজও বাঙালির স্মৃতিতে বেঁচে আছেন এই অভিনেত্রী। অভিনেত্রী প্রচুর প্রতিভা নিয়ে এসেছিলেন এবং কয়েক বছর ধরে বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পকে শাসন করেছেন। 


অভিনেত্রীর পাশের বাড়ির মেয়ে ইমেজ এবং তার অভিনয় প্রতিভা ছিল তার টিআরপি। সেই সময়ের মহুয়ার ভক্তরা এখন প্রবীণ। কিন্তু ঘটনা হল বর্তমান সময়ের তরুণরাও মহুয়ার ভক্ত। এর পিছনে জাদু কি?


সুচিত্রা সেন তার সময়ে ড্রিমগার্ল ছিলেন কিন্তু আজ এই অভিনেত্রীকে নিয়ে তেমন ক্রেজ দেখা যায় না। সুচিত্রা সেন দীর্ঘদিন ইন্ডাস্ট্রিতে ছিলেন কিন্তু 38 বছর আগে মহুয়া মারা যান এবং ইন্ডাস্ট্রিতে তার আয়ু খুব কম ছিল।


মহুয়া ম্যাজিক মূলত তার বোন ইমেজ এর জন্য। মহুয়া অবশ্যই অনেক পুরুষ ভক্তের ড্রিমগার্ল ছিল এবং তার অনেক মহিলা ভক্ত তার সৌন্দর্য পছন্দ করেছিল কিন্তু তার বেশিরভাগ ভক্ত তাকে তাদের বোন হিসাবে বিবেচনা করেছিল। তাই, তারা আজও তাদের বোনকে স্মরণ করে এবং মনে রাখবে।


বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় মহুয়া খুব নরম মনের এবং সে একজন ভালো মা ছিল। এমনও শোনা যায় যে তিনি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অনেক লোককে আর্থিকভাবে সাহায্য করেছেন। তিনি পশু প্রেমিক ছিলেন। এমন মহিলা খারাপ স্ত্রী হতে পারে না। সম্ভবত তিনি তার পরিবারের সদস্যদের জন্য অর্থ উপার্জনের মেশিন ছিলেন।


আশা করি মহুয়া ইতিমধ্যে একটি নতুন জীবন পেয়েছে এবং এটি তার আগের জীবনের সমস্ত কষ্টের ক্ষতিপূরণ করবে




মহুয়া রায়চৌধুরীর অসুখী বিবাহিত জীবন নিয়ে বিপ্লব চ্যাটার্জি

 বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় তাঁর স্পষ্ট বক্তব্যের জন‍্য প্রবাদপ্রতিম। আপনি ওনার কথা পছন্দ করতে পারেন, না পারেন – কিন্তু অগ্রাহ্য করতে পারবেন না। আজও মনে পড়ছে ,  বছর দুয়েক আগে গৌতম ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় ' তারাদের শেষ তর্পণ ' অনুষ্ঠানে ওনার বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে মহুয়া রায়চৌধুরীর স্মৃতিচারণ। শুনতে শুনতে অজান্তেই চোখের কোল বেয়ে জলের ধারা নেমেছিল।

               আপনাদের মধ‍্যে বিশাল সংখ‍্যক মানুষ বিপ্লব চট্টোপাধ‍্যায়কে জানতে ও তাঁর কাছ থেকে মহুয়া রায়চৌধুরীর কথা শুনতে নিশ্চিতভাবেই ভীষণ আগ্রহী। তাঁরা সংগ্রহে রাখতে পারেন এই বইটি। বইটি সংগ্রহ করার জন‍্য ফোন নম্বরও দেওয়া আছে।



কমল বন্দোপাধ্যায়ের ফেসবুক পেজ থেকে মহুয়া রায়চৌধুরী সম্পর্কে

 কমল বন্দোপাধ্যায়ের ফেসবুক পেজ থেকে:- গতকাল ঠিক যেখানে শেষ করেছিলাম , ঠিক সেখান থেকেই শুরু করি । যে সময়ের কথা বলছি অর্থাৎ ...