মহুয়া রায়চৌধুরীর স্মৃতিচারণ প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সাংবাদিক রবি বসুর কন্যা মনোয়ী দাঁর


 মনে পড়ছে মহুয়া রায়চৌধুরীর সাথে ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রথম পরিচয় হওয়ার দিনটা। তখন আমার বয়স বড়জোর ৬ কি ৭ , কিন্তু সবকিছু এখনো ছবির মত স্পষ্ট আমার কাছে। সে দিন আমরা ছিলাম নব্যেন্দু কাকুর (পরিচালক নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়) বাড়িতে। সকাল থেকেই সবাই ব্যস্ত, বোলপুরে 'আজ কাল পরশুর গল্প' ছবির শুটিং শুরু হবে। সকাল থেকে সাজো সাজো রব নব্যেন্দু কাকুর বাড়িতে বোলপুর যাত্রার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার জন্য। বাপি আর দাদা তো ছিলই , এমনকি আমার মা আর মাসিও সেবার বোলপুর যাচ্ছিলেন, যেহেতু আমার মাসতুতো ভাই টুবলুকে মহুয়ার ছেলের চরিত্রে কাস্ট করা হয়েছিল। তো যাই হোক , নব্যেন্দু কাকুর বাড়িতে তো আমাদের অবাধ যাতায়াত ছিল, কাকিমা (নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী) আমাদের দুই বোনকে খুব ভালবাসতেন, কাকিমা আমায় জিজ্ঞেস করলেন , "তোর মৌয়ের (মহুয়া) সাথে আলাপ হয়েছে?" আমি বললাম "না আমার সাথে আলাপ নেই"। আমার মামার বাড়ি হেদুয়ার অলক চক্রবর্তীর (পরিচালক/তিলকের দাদা) বাড়ির একটা বাড়ি পরে , মহুয়া রায় চৌধুরী বিয়ের পর বছর দুয়েক সেখানে ছিলেন। তাই আমার মায়ের সাথে অল্পবিস্তর পরিচয় ছিল, আর বাবার আর দাদার সাথে তো কাজের সূত্রে ওনার হৃদ্যতা, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তখনও আমার সাথে পরিচয় ছিল না। কাকিমা বললেন "আজ মৌ আসবে , তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেব"। তখন অবধি হল-এ গিয়ে আমি মহুয়া রায়চৌধুরীর একটা সিনেমাই দেখেছি 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ' । তখন এত ছোট ছিলাম আমি সিনেমার কিছুই বুঝতাম না। বাড়ির সবাই গিয়েছিল তাই আমাকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু তখন থেকেই টিকলি পড়া মিষ্টি বউ সাজা মেয়েটার মুখটা আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল, সবাইকে বলতাম "ওই টিকলি পড়া মেয়েটাকে আমার খুব ভালো লাগে"। ওনার নামটাও জানতাম না, কিন্তু পরবর্তীকালে টেলিভিশনের দৌলতে ওনার অনেক ছবি আমি তখন দেখে ফেলেছি : যেমন অজস্র ধন্যবাদ, আনন্দমেলা, শেষ রক্ষা ইত্যাদি, এবং যথারীতি আমার ভীষণ প্রিয় অভিনেত্রী হয়ে উঠেছেন উনি। তো সেদিন নব্যেন্দু কাকুর বাড়িতে কাকীমা যখন বললেন আজ তোর সাথে মৌয়ের আলাপ করিয়ে দেব তখন আমিও খুব উত্তেজিত হয়েছিলাম প্রিয় নায়িকাকে কাছ থেকে দেখার জন্য। একে একে সব অভিনেতারা আসতে শুরু করেছেন, যথা সময়ে মহুয়া রায় চৌধুরীর গাড়ি এলো এবং ছোট্ট গোলাকে নিয়ে উনি নেমে এলেন গাড়ি থেকে। সেদিন উনি শার্ট প্যান্ট পড়েছিলেন যাতায়াতের সুবিধার জন্য, আর ছোট্ট গোলাকে লাল টুকটুকে গেঞ্জি প্যান্ট পড়ে রাজপুত্রের মত লাগছিল। ওতো এসেই ওর সঙ্গী টুবলুর (আমার ভাই) সাথে খেলতে আরম্ভ করে দিল, মহুয়ার সেদিন মুড অফ ছিল কারণ ওনার স্বামীর ভীষণ জ্বর , তাই আসতে পারেননি। যাই হোক , কাকিমা এত ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের দুই বোনের হাত ধরে মৌ -এর কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন "মৌ , তোমার অনেক বড় দুজন ফ্যান তোমার সাথে আলাপ করবে বলে বসে আছে, রবিদার দুই মেয়ে"। উনি সেই কথা শুনে আমাদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে জোড়হাত করে এমন ভাবে আমাদের নমস্কার জানালেন যেন মন্দিরে দেবতা দর্শন করছেন, আমি ব্যাপারটায় খুব বিস্মিত হয়ে গেছিলাম। এত ছোট বাচ্চাদের সাথে পরিচয় হলে লোকে বড়জোর গাল টিপে আদর করে , এভাবে ভক্তি ভরে নমস্কার জানাতে তো কখনো দেখিনি! পরবর্তীকালে আমি উপলব্ধি করি যে নিজের প্রফেশন সম্বন্ধে একজন মানুষের কতখানি শ্রদ্ধা ভালবাসা থাকলে মানুষ শুধুমাত্র ওনার 'ফ্যান' কথাটা শুনে তাদের ভগবান দর্শন করার মতো করে প্রণাম জানায় , সেই জন্যই তো তিনি আজও মানুষের কাছে অমর হয়ে আছেন, ভীষণ ভালোবাসার একজন অভিনেত্রী হয়ে ছিলেন, আছেন, থাকবেন।


মহুয়া রায়চৌধুরীর জীবনে আমার মত একজন সাধারন ফ্যানের সামান্যতম অবদান আছে এটা ভাবলে আমি নিজে নিজেই গর্ববোধ করি। এই ঘটনাটা আরও আগের, সেদিন নব্যেন্দু কাকু আমাদের বাড়িতে বসে বাবার সাথে 'আজ কাল পরশুর গল্প' ছবির কাস্টিং নিয়ে আলোচনা করছেন, আমি কাকুর খুব ন্যাওটা ছিলাম , কাকুও আমায় খুব স্নেহ করতেন, গেলেই আমায় কাছে টেনে নিয়ে আদর করতেন , আমার সব আবদার মেটাতেন ; বিনিময়ে আমায় কাকুর মাথার পাকা চুল বেছে দিতে হতো, যদিও পাকা চুল সেরকম ছিল না। যাইহোক , সেই রকমই একটা দিনে আমি পাকা চুল বাছছি আর বাপি আর কাকুর কাস্টিং নিয়ে আলোচনা শুনছি। ওরা একটা গ্রামের বউয়ের চরিত্রে কাকে নেওয়া যায় আলোচনা করছেন, সন্ধ্যা রায়ের কথা উঠতে কাকু বললেন , আমি এই ছবিতে ঠিক 'ফুলেশ্বরী' ছবির ইমেজটা চাইছি না, 'বালিকা বধূ' ছবির মৌসুমী চ্যাটার্জির কথা উঠলো। সেখানে একটা সমস্যা উনি তখন বম্বেতে ভীষণ ব্যস্ত এবং গ্ল্যামারাস নায়িকা হয়ে উঠেছেন, ওনাকে ডি গ্ল্যামারাইজ করলেও এই ছবির ইমেজ নষ্ট হবে, যেহেতু এটা আর্ট ফিল্ম । এই ধরনের আলোচনা ওদের মধ্যে চলছে, আমার মনে তো একজনেরই মুখ ভেসে উঠছে সে হল মহুয়া রায়চৌধুরী । কিন্তু বলতে সাহস পাচ্ছিনা, কারণ বাবা পছন্দ করতেন না বড়দের মধ্যে কথা বলা। যাই হোক , অবশেষে থাকতে না পেরে কাকুর কাছে বলেই বসলাম "কাকু , মহুয়া রায়চৌধুরীকে নাও না গো"।কাকু কথাটা শুনলেন এবং বাপিকে জিজ্ঞেস করলেন "রবিদা মহুয়াকে নিলে কেমন হবে?" বাপি বললো "ভালো হবে! খুব ভালো হবে!"- বাকিটা তো ইতিহাস। এই ছবিতে মহুয়া রায়চৌধুরী অভিনয় করে সেবছর শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছিলেন, এবং ওনাকে অভিনেত্রী হিসেবে অন্য লেভেলে পৌঁছে দিয়েছিল এই ছবি। পরবর্তীকালে কোনো এক সাক্ষাৎকারে ওনাকে আমি বলতে শুনেছি যে "আজকাল পরশুর গল্পের মত চরিত্র আর পেলাম কোথায়!" যাইহোক আমার দুঃখ একটাই রয়ে গেল ।সেই দিনের ওনার সেই ছোট্ট ফ্যানটি এই ছবিতে অভিনয় করার জন্য ওনার নাম সাজেস্ট করেছিল সেটা উনি কোনো দিন জানতে পারলেন না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ মুক্তির বছরখানেক পর মহুয়া রায়চৌধুরীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার

 বাংলা ছবির সেই সময়কার অন্যতম জনপ্রিয় নায়িকা ছিলেন তিনি। তাঁর নামে প্রেক্ষাগৃহ হাউজ়ফুল হতো। প্রথম ছবি ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ মুক্তির বছরখানেক ...