প্রবীর রায়ের চোখে মহুয়া রায়চৌধুরী

প্রবীর রায় ' আজ কাল পরশুর গল্প '- তেও অভিনয় করেছেন।) বিস্তারিত বলেছেন মহুয়া রায়চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতার কথা - 'মহুয়াকে যেমন চিনি'


মহুয়ার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় বোধহয় সাতের দশকের মাঝামাঝি।
পরিচালক নীতিশ মুখার্জী ঠিক করলেন শীর্ষেন্দু মুখার্জীর উপন্যাস "নয়ন শ্যামা" ফিল্ম করবেন। নতুন নায়ক খোঁজা শুরু হলো। অডিশন দিয়ে আমি নির্বাচিত হলাম "নয়ন" এর ভূমিকায়। "শ্যামা"র চরিত্রে উনি প্রতিষ্ঠিত নায়িকা সুমিত্রা মুখার্জীকে নির্বাচিত করলেন। ফিল্মে আর একটা ইম্পরট্যান্ট ক্যারেক্টার সন্তু মুখার্জী , একজন সাঁপুড়ে। সন্তুর বিপরীতে নীতীশদা মহুয়ার কথা ভাবলেন। তখন মহুয়ার বিয়ে হয়নি। থাকতো দমদমে ক্লাইভ রোডে টেলিফোন ডিপার্টমেন্টের কোয়ার্টারে। মহুয়ার মা চাকরি করতেন। মহুয়ার বাবার নাম ছিল নীলাঞ্জন। আমরা নীলুদা বলতাম।

মহুয়ার সঙ্গে কথা বলতে নীতীশদা আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। সেই মহুয়ার সঙ্গে প্রথম আলাপ। মহুয়া রাজি হয়ে গেলো। নীতীশদাও খুশি , আমরা খুশি মনে ফিরে এলাম। আর একটা রোমান্টিক চরিত্রে রঞ্জিত মল্লিক। কাস্ট ফাইনাল। শ্যুটের তোড়জোড় শুরু হলো। দিন ফাইনাল হলো। আমরা যাবো আউটডোরে - মল্লিকপুরে। সব ঠিক। এই সময়ে এলো খারাপ খবর। শুটে যাওয়ার দুদিন আগে মহুয়ার পক্স। আমরা ছুটলাম দমদমে মহুয়ার বাড়ি। ও মশারির ভিতর আর আমরা বাইরে, কথা হলো , সব হলো কিন্তু মহুয়ার পক্ষে করা সম্ভব হলো না।

"নয়ন শ্যামা" তে মহুয়ার করা হলো না কিন্তু আমার সঙ্গে ভাব রয়ে গেলো। সেই ভাব আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করলো। এটা বোধহয় ১৯৭৫সালের কথা। আমি তখন থাকতাম , গোলপার্কে "সপ্তর্ষি" হোটেলে একটা রুম নিয়ে। আমারও জীবনে তখন ডামাডোল। মহুয়া তখন শুট আর নহবত নাটক নিয়ে ব্যস্ত। শুট তাড়াতাড়ি শেষ হলে চলে আসতো সপ্তর্ষিতে। তখনকার অনেকেই সপ্তর্ষিতে আসতো আড্ডা মারতে। শমিত ভঞ্জ, রমেন রায়চৌধুরী , বিপ্লব চ্যাটার্জী, আরো অনেকে। মহুয়ার মধ্যে একটা অদ্ভুত মিষ্টি মন ছিল , অন্যকে বোঝার মতো একটা অনুভূতি ওর মধ্যে কাজ করতো। একটা ফিলিংস ছিল অন্যের জন্য। একটা ছোট্ট ঘটনা বলছি , সবাই এসে আড্ডা মারতে মারতে খাবার অর্ডার দিতো , পেমেন্ট আমাকেই করতে হতো বেশিরভাগ সময়ে। কিন্তু মৌ যখনি অর্ডার করতো , নিজে পেমেন্ট করতো। হাজার বললেও শুনতো না।
এই রকম আড্ডা মারতে মারতে আমরা সবাই একদিন ঠিক করলাম একটা নাটকের গ্রুপ করলে কেমন হয়। কল শো করবো। বুবুর (শমিত ) মেজদা তখন বার্নপুরে চাকরি করতেন। উনি ওখানকার রোটারি ক্লাবের একটা কল শো দিলেন আমাদের। নাটক ঠিক হলো নীতিশ সেনের " বর্বর বাঁশি " । তিন ভাই আর এক বোনের গল্প। বড় ভাই শমিত , মেজো ভাই আমি , ছোট ভাই বিপ্লব আর বোন মহুয়া। পরিচালক বিপ্লব। জোর কদমে রিহার্সাল শুরু হয় গেলো। রিহার্সাল না থাকলে, মৌ-র শুট না থাকলে আমি চলে যেতাম দমদমে ওর ফ্ল্যাটে। নীলুদার সঙ্গেও খুব ভাব হয় গিয়েছিলো। ওর ওখান থেকে আমি আর মৌ নাইট শোতে মাঝে মাঝে সিনেমা দেখতে চলে যেতাম "জয়া" সিনেমা হলে। সিনেমা দেখে রিক্সা করে ওকে বাড়ি পৌঁছে আমি ফিরতাম গোলপার্কে। একদিন সিনেমা দেখতে গিয়ে ওর উপর খুব রেগে গেলাম।
ঝগড়া হলো। কারণটা হলো ও খুব পান খেত পাকা বুড়ির মতো। একদিন পান খেয়ে হলের মধ্যেই পানের পিক ফেলেছিল। আমি খুব রেগে গিয়েছিলাম। এই গুলো কিন্তু সবই ওর ছেলেমানুষি। সেদিনের ফিল্মের নামটাও মনে আছে "হোটেল স্নো ফক্স ক্যাবারে "। সেই ফিল্মের সঙ্গে সেদিন ট্রেইলার দেখানো হয়েছিল "আনন্দমেলা' র , যাতে উত্তমকুমার ছাড়াও মহুয়া আর তিলক ছিল।

সেই সময়ে হঠাৎ ও জানালো ও নাটকে অভিনয় করতে পারবে না। আমাদের তো মাথায় হাত, আর ৭ দিন পরেই শো। রিহার্সাল থেকে ওই রাতেই ছুটলাম দমদমে। আমি, বুবু আর বিপ্লব। সেদিন বারান্দায় নিয়ে গিয়ে আমাকে আলাদা করে বলেছিলো কেন ও করতে পারবে না। সেটা এখানে আমি বলতে পারবো না। সেই ক্যারেক্টারটা করেছিলেন সোমা দে। নাটক খুব সাকসেসফুল হয়েছিল। বুবু অসাধারণ অভিনয় করেছিল। শো এর পর বার্নপুর ক্লাবে আমাদের বিরাট পার্টি দেওয়া হয়েছিল।

ফিরে আসার পর আমাদের সম্পর্ক ঠিকই ছিল। একদিন শঙ্করদার "শেষ রক্ষা"র সেট -এ গেলাম। মৌ-র সঙ্গে দেখা করতে। তারপর দিন ওর শো ছিল "নহবত" এর। আমাকে বললো , দরকার আছে তোমার সঙ্গে , কাল একবার ফার্স্ট শোর পর আসবে ?? আমি বললাম হ্যাঁ যাবো।

পরের দিন ফার্স্ট শোএর পর গেলাম। স্টেজে বসে সবাই আড্ডা মারছিলো। মৌ, বুড়ো মামু (তরুণকুমার), প্রদীপ মুখার্জী ও আরো অনেকে। আমাকে তপন থিয়েটারের পেছনে নিয়ে গেলো। পেছনে তখন খাটাল মতো ছিল। ওখানে একটা খাটিয়াতে বসে অনেক কিছু বললো, ওর দুঃখের কথা , আরো অনেক কিছু। সেসব এখানে শেয়ার করা সম্ভব না। সেদিন ও কান্নাকাটিও করেছিল। তার পরের দিন আমি চলে গিয়েছিলাম "নয়ন শ্যামা" র অউটডোরে বাদুড়িয়াতে। সাত দিন পর ফিরে দেখা করতে গিয়েছিলাম ইন্দ্রপুরী ষ্টুডিওতে। ঘরটা অন্ধকার ছিল , আমি নক করে ঢুকলাম। দেখলাম মাথা ভর্তি সিঁদুর। আমি বললাম বাহ্ , দারুন মেকআপ হয়েছে তো !! ও বললো মেকআপ না, আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমি অবাক হয়ে গেলাম , কারণ সাতদিন আগে যা কথা হয়েছে , তাতে এখন বিয়ে হওয়ার কথা ছিল না। বললাম যা হয়েছে ভালোর জন্য।
এর পর আমাদের দেখা সাক্ষাৎ কমে গিয়েছিলো। এক দু বার বোধহয় ওর নানুবাবুর বাজারের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম।
এর পর দেখা "আজ কাল পরশুর গল্প" ফিল্মের শুটে বোলপুরে। সেখানেও একদিন ওর রুমে বসে আড্ডা মারলাম, একই মন কেমন করা গল্প।
মেয়েটা Misunderstood রয়ে গেলো। একটু বোধহয় বেশি লাগাম ছাড়া হয়ে গিয়েছিলো। শেষ দেখা আমার সঙ্গে India Film Labortary তে। সেই সময় ওর হাত ভেঙেছিল। প্লাস্টার নিয়ে এসেছিলো "আজ কাল পরশুর গল্প" র ডাবিংয়ে। ছোট থেকে খালি উপার্জন করে করেই হাঁপিয়ে উঠেছিল। অথচ কি বড় মাপের অভিনেত্রী !

ওর ধারে কাছে যাওয়ার মতো অভিনেত্রী আজ বাংলায় কেউ নেই। একটা বিরাট প্রতিভা অকালে ঝরে গেলো। আর অভিনয় জগৎও হারালো এক অসাধারণ অভিনেত্রী আর ভীষণ ভালো মনের একটা মানুষকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

অদ্বিতীয়া মহুয়া : ছ'জন অভিনেত্রীর চোখে

রত্না ঘোষাল এগারোই জুলাই বিকেলে মৌ আমার বাড়িতে এসেছিল। এই ঘরে বসেই অনেক আড্ডা হল। সেদিন হেস্পতিবার, 'তপন থিয়েটারে' আমাদের 'নাগ...