মহুয়া রায়চৌধুরীর স্মৃতিচারণ প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সাংবাদিক রবি বসুর কন্যা মনোয়ী দাঁর


 মনে পড়ছে মহুয়া রায়চৌধুরীর সাথে ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রথম পরিচয় হওয়ার দিনটা। তখন আমার বয়স বড়জোর ৬ কি ৭ , কিন্তু সবকিছু এখনো ছবির মত স্পষ্ট আমার কাছে। সে দিন আমরা ছিলাম নব্যেন্দু কাকুর (পরিচালক নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়) বাড়িতে। সকাল থেকেই সবাই ব্যস্ত, বোলপুরে 'আজ কাল পরশুর গল্প' ছবির শুটিং শুরু হবে। সকাল থেকে সাজো সাজো রব নব্যেন্দু কাকুর বাড়িতে বোলপুর যাত্রার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার জন্য। বাপি আর দাদা তো ছিলই , এমনকি আমার মা আর মাসিও সেবার বোলপুর যাচ্ছিলেন, যেহেতু আমার মাসতুতো ভাই টুবলুকে মহুয়ার ছেলের চরিত্রে কাস্ট করা হয়েছিল। তো যাই হোক , নব্যেন্দু কাকুর বাড়িতে তো আমাদের অবাধ যাতায়াত ছিল, কাকিমা (নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী) আমাদের দুই বোনকে খুব ভালবাসতেন, কাকিমা আমায় জিজ্ঞেস করলেন , "তোর মৌয়ের (মহুয়া) সাথে আলাপ হয়েছে?" আমি বললাম "না আমার সাথে আলাপ নেই"। আমার মামার বাড়ি হেদুয়ার অলক চক্রবর্তীর (পরিচালক/তিলকের দাদা) বাড়ির একটা বাড়ি পরে , মহুয়া রায় চৌধুরী বিয়ের পর বছর দুয়েক সেখানে ছিলেন। তাই আমার মায়ের সাথে অল্পবিস্তর পরিচয় ছিল, আর বাবার আর দাদার সাথে তো কাজের সূত্রে ওনার হৃদ্যতা, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তখনও আমার সাথে পরিচয় ছিল না। কাকিমা বললেন "আজ মৌ আসবে , তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেব"। তখন অবধি হল-এ গিয়ে আমি মহুয়া রায়চৌধুরীর একটা সিনেমাই দেখেছি 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ' । তখন এত ছোট ছিলাম আমি সিনেমার কিছুই বুঝতাম না। বাড়ির সবাই গিয়েছিল তাই আমাকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু তখন থেকেই টিকলি পড়া মিষ্টি বউ সাজা মেয়েটার মুখটা আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল, সবাইকে বলতাম "ওই টিকলি পড়া মেয়েটাকে আমার খুব ভালো লাগে"। ওনার নামটাও জানতাম না, কিন্তু পরবর্তীকালে টেলিভিশনের দৌলতে ওনার অনেক ছবি আমি তখন দেখে ফেলেছি : যেমন অজস্র ধন্যবাদ, আনন্দমেলা, শেষ রক্ষা ইত্যাদি, এবং যথারীতি আমার ভীষণ প্রিয় অভিনেত্রী হয়ে উঠেছেন উনি। তো সেদিন নব্যেন্দু কাকুর বাড়িতে কাকীমা যখন বললেন আজ তোর সাথে মৌয়ের আলাপ করিয়ে দেব তখন আমিও খুব উত্তেজিত হয়েছিলাম প্রিয় নায়িকাকে কাছ থেকে দেখার জন্য। একে একে সব অভিনেতারা আসতে শুরু করেছেন, যথা সময়ে মহুয়া রায় চৌধুরীর গাড়ি এলো এবং ছোট্ট গোলাকে নিয়ে উনি নেমে এলেন গাড়ি থেকে। সেদিন উনি শার্ট প্যান্ট পড়েছিলেন যাতায়াতের সুবিধার জন্য, আর ছোট্ট গোলাকে লাল টুকটুকে গেঞ্জি প্যান্ট পড়ে রাজপুত্রের মত লাগছিল। ওতো এসেই ওর সঙ্গী টুবলুর (আমার ভাই) সাথে খেলতে আরম্ভ করে দিল, মহুয়ার সেদিন মুড অফ ছিল কারণ ওনার স্বামীর ভীষণ জ্বর , তাই আসতে পারেননি। যাই হোক , কাকিমা এত ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের দুই বোনের হাত ধরে মৌ -এর কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন "মৌ , তোমার অনেক বড় দুজন ফ্যান তোমার সাথে আলাপ করবে বলে বসে আছে, রবিদার দুই মেয়ে"। উনি সেই কথা শুনে আমাদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে জোড়হাত করে এমন ভাবে আমাদের নমস্কার জানালেন যেন মন্দিরে দেবতা দর্শন করছেন, আমি ব্যাপারটায় খুব বিস্মিত হয়ে গেছিলাম। এত ছোট বাচ্চাদের সাথে পরিচয় হলে লোকে বড়জোর গাল টিপে আদর করে , এভাবে ভক্তি ভরে নমস্কার জানাতে তো কখনো দেখিনি! পরবর্তীকালে আমি উপলব্ধি করি যে নিজের প্রফেশন সম্বন্ধে একজন মানুষের কতখানি শ্রদ্ধা ভালবাসা থাকলে মানুষ শুধুমাত্র ওনার 'ফ্যান' কথাটা শুনে তাদের ভগবান দর্শন করার মতো করে প্রণাম জানায় , সেই জন্যই তো তিনি আজও মানুষের কাছে অমর হয়ে আছেন, ভীষণ ভালোবাসার একজন অভিনেত্রী হয়ে ছিলেন, আছেন, থাকবেন।


মহুয়া রায়চৌধুরীর জীবনে আমার মত একজন সাধারন ফ্যানের সামান্যতম অবদান আছে এটা ভাবলে আমি নিজে নিজেই গর্ববোধ করি। এই ঘটনাটা আরও আগের, সেদিন নব্যেন্দু কাকু আমাদের বাড়িতে বসে বাবার সাথে 'আজ কাল পরশুর গল্প' ছবির কাস্টিং নিয়ে আলোচনা করছেন, আমি কাকুর খুব ন্যাওটা ছিলাম , কাকুও আমায় খুব স্নেহ করতেন, গেলেই আমায় কাছে টেনে নিয়ে আদর করতেন , আমার সব আবদার মেটাতেন ; বিনিময়ে আমায় কাকুর মাথার পাকা চুল বেছে দিতে হতো, যদিও পাকা চুল সেরকম ছিল না। যাইহোক , সেই রকমই একটা দিনে আমি পাকা চুল বাছছি আর বাপি আর কাকুর কাস্টিং নিয়ে আলোচনা শুনছি। ওরা একটা গ্রামের বউয়ের চরিত্রে কাকে নেওয়া যায় আলোচনা করছেন, সন্ধ্যা রায়ের কথা উঠতে কাকু বললেন , আমি এই ছবিতে ঠিক 'ফুলেশ্বরী' ছবির ইমেজটা চাইছি না, 'বালিকা বধূ' ছবির মৌসুমী চ্যাটার্জির কথা উঠলো। সেখানে একটা সমস্যা উনি তখন বম্বেতে ভীষণ ব্যস্ত এবং গ্ল্যামারাস নায়িকা হয়ে উঠেছেন, ওনাকে ডি গ্ল্যামারাইজ করলেও এই ছবির ইমেজ নষ্ট হবে, যেহেতু এটা আর্ট ফিল্ম । এই ধরনের আলোচনা ওদের মধ্যে চলছে, আমার মনে তো একজনেরই মুখ ভেসে উঠছে সে হল মহুয়া রায়চৌধুরী । কিন্তু বলতে সাহস পাচ্ছিনা, কারণ বাবা পছন্দ করতেন না বড়দের মধ্যে কথা বলা। যাই হোক , অবশেষে থাকতে না পেরে কাকুর কাছে বলেই বসলাম "কাকু , মহুয়া রায়চৌধুরীকে নাও না গো"।কাকু কথাটা শুনলেন এবং বাপিকে জিজ্ঞেস করলেন "রবিদা মহুয়াকে নিলে কেমন হবে?" বাপি বললো "ভালো হবে! খুব ভালো হবে!"- বাকিটা তো ইতিহাস। এই ছবিতে মহুয়া রায়চৌধুরী অভিনয় করে সেবছর শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছিলেন, এবং ওনাকে অভিনেত্রী হিসেবে অন্য লেভেলে পৌঁছে দিয়েছিল এই ছবি। পরবর্তীকালে কোনো এক সাক্ষাৎকারে ওনাকে আমি বলতে শুনেছি যে "আজকাল পরশুর গল্পের মত চরিত্র আর পেলাম কোথায়!" যাইহোক আমার দুঃখ একটাই রয়ে গেল ।সেই দিনের ওনার সেই ছোট্ট ফ্যানটি এই ছবিতে অভিনয় করার জন্য ওনার নাম সাজেস্ট করেছিল সেটা উনি কোনো দিন জানতে পারলেন না।

প্রবীর রায়ের চোখে মহুয়া রায়চৌধুরী

প্রবীর রায় ' আজ কাল পরশুর গল্প '- তেও অভিনয় করেছেন।) বিস্তারিত বলেছেন মহুয়া রায়চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতার কথা - 'মহুয়াকে যেমন চিনি'


মহুয়ার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় বোধহয় সাতের দশকের মাঝামাঝি।
পরিচালক নীতিশ মুখার্জী ঠিক করলেন শীর্ষেন্দু মুখার্জীর উপন্যাস "নয়ন শ্যামা" ফিল্ম করবেন। নতুন নায়ক খোঁজা শুরু হলো। অডিশন দিয়ে আমি নির্বাচিত হলাম "নয়ন" এর ভূমিকায়। "শ্যামা"র চরিত্রে উনি প্রতিষ্ঠিত নায়িকা সুমিত্রা মুখার্জীকে নির্বাচিত করলেন। ফিল্মে আর একটা ইম্পরট্যান্ট ক্যারেক্টার সন্তু মুখার্জী , একজন সাঁপুড়ে। সন্তুর বিপরীতে নীতীশদা মহুয়ার কথা ভাবলেন। তখন মহুয়ার বিয়ে হয়নি। থাকতো দমদমে ক্লাইভ রোডে টেলিফোন ডিপার্টমেন্টের কোয়ার্টারে। মহুয়ার মা চাকরি করতেন। মহুয়ার বাবার নাম ছিল নীলাঞ্জন। আমরা নীলুদা বলতাম।

মহুয়ার সঙ্গে কথা বলতে নীতীশদা আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। সেই মহুয়ার সঙ্গে প্রথম আলাপ। মহুয়া রাজি হয়ে গেলো। নীতীশদাও খুশি , আমরা খুশি মনে ফিরে এলাম। আর একটা রোমান্টিক চরিত্রে রঞ্জিত মল্লিক। কাস্ট ফাইনাল। শ্যুটের তোড়জোড় শুরু হলো। দিন ফাইনাল হলো। আমরা যাবো আউটডোরে - মল্লিকপুরে। সব ঠিক। এই সময়ে এলো খারাপ খবর। শুটে যাওয়ার দুদিন আগে মহুয়ার পক্স। আমরা ছুটলাম দমদমে মহুয়ার বাড়ি। ও মশারির ভিতর আর আমরা বাইরে, কথা হলো , সব হলো কিন্তু মহুয়ার পক্ষে করা সম্ভব হলো না।

"নয়ন শ্যামা" তে মহুয়ার করা হলো না কিন্তু আমার সঙ্গে ভাব রয়ে গেলো। সেই ভাব আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করলো। এটা বোধহয় ১৯৭৫সালের কথা। আমি তখন থাকতাম , গোলপার্কে "সপ্তর্ষি" হোটেলে একটা রুম নিয়ে। আমারও জীবনে তখন ডামাডোল। মহুয়া তখন শুট আর নহবত নাটক নিয়ে ব্যস্ত। শুট তাড়াতাড়ি শেষ হলে চলে আসতো সপ্তর্ষিতে। তখনকার অনেকেই সপ্তর্ষিতে আসতো আড্ডা মারতে। শমিত ভঞ্জ, রমেন রায়চৌধুরী , বিপ্লব চ্যাটার্জী, আরো অনেকে। মহুয়ার মধ্যে একটা অদ্ভুত মিষ্টি মন ছিল , অন্যকে বোঝার মতো একটা অনুভূতি ওর মধ্যে কাজ করতো। একটা ফিলিংস ছিল অন্যের জন্য। একটা ছোট্ট ঘটনা বলছি , সবাই এসে আড্ডা মারতে মারতে খাবার অর্ডার দিতো , পেমেন্ট আমাকেই করতে হতো বেশিরভাগ সময়ে। কিন্তু মৌ যখনি অর্ডার করতো , নিজে পেমেন্ট করতো। হাজার বললেও শুনতো না।
এই রকম আড্ডা মারতে মারতে আমরা সবাই একদিন ঠিক করলাম একটা নাটকের গ্রুপ করলে কেমন হয়। কল শো করবো। বুবুর (শমিত ) মেজদা তখন বার্নপুরে চাকরি করতেন। উনি ওখানকার রোটারি ক্লাবের একটা কল শো দিলেন আমাদের। নাটক ঠিক হলো নীতিশ সেনের " বর্বর বাঁশি " । তিন ভাই আর এক বোনের গল্প। বড় ভাই শমিত , মেজো ভাই আমি , ছোট ভাই বিপ্লব আর বোন মহুয়া। পরিচালক বিপ্লব। জোর কদমে রিহার্সাল শুরু হয় গেলো। রিহার্সাল না থাকলে, মৌ-র শুট না থাকলে আমি চলে যেতাম দমদমে ওর ফ্ল্যাটে। নীলুদার সঙ্গেও খুব ভাব হয় গিয়েছিলো। ওর ওখান থেকে আমি আর মৌ নাইট শোতে মাঝে মাঝে সিনেমা দেখতে চলে যেতাম "জয়া" সিনেমা হলে। সিনেমা দেখে রিক্সা করে ওকে বাড়ি পৌঁছে আমি ফিরতাম গোলপার্কে। একদিন সিনেমা দেখতে গিয়ে ওর উপর খুব রেগে গেলাম।
ঝগড়া হলো। কারণটা হলো ও খুব পান খেত পাকা বুড়ির মতো। একদিন পান খেয়ে হলের মধ্যেই পানের পিক ফেলেছিল। আমি খুব রেগে গিয়েছিলাম। এই গুলো কিন্তু সবই ওর ছেলেমানুষি। সেদিনের ফিল্মের নামটাও মনে আছে "হোটেল স্নো ফক্স ক্যাবারে "। সেই ফিল্মের সঙ্গে সেদিন ট্রেইলার দেখানো হয়েছিল "আনন্দমেলা' র , যাতে উত্তমকুমার ছাড়াও মহুয়া আর তিলক ছিল।

সেই সময়ে হঠাৎ ও জানালো ও নাটকে অভিনয় করতে পারবে না। আমাদের তো মাথায় হাত, আর ৭ দিন পরেই শো। রিহার্সাল থেকে ওই রাতেই ছুটলাম দমদমে। আমি, বুবু আর বিপ্লব। সেদিন বারান্দায় নিয়ে গিয়ে আমাকে আলাদা করে বলেছিলো কেন ও করতে পারবে না। সেটা এখানে আমি বলতে পারবো না। সেই ক্যারেক্টারটা করেছিলেন সোমা দে। নাটক খুব সাকসেসফুল হয়েছিল। বুবু অসাধারণ অভিনয় করেছিল। শো এর পর বার্নপুর ক্লাবে আমাদের বিরাট পার্টি দেওয়া হয়েছিল।

ফিরে আসার পর আমাদের সম্পর্ক ঠিকই ছিল। একদিন শঙ্করদার "শেষ রক্ষা"র সেট -এ গেলাম। মৌ-র সঙ্গে দেখা করতে। তারপর দিন ওর শো ছিল "নহবত" এর। আমাকে বললো , দরকার আছে তোমার সঙ্গে , কাল একবার ফার্স্ট শোর পর আসবে ?? আমি বললাম হ্যাঁ যাবো।

পরের দিন ফার্স্ট শোএর পর গেলাম। স্টেজে বসে সবাই আড্ডা মারছিলো। মৌ, বুড়ো মামু (তরুণকুমার), প্রদীপ মুখার্জী ও আরো অনেকে। আমাকে তপন থিয়েটারের পেছনে নিয়ে গেলো। পেছনে তখন খাটাল মতো ছিল। ওখানে একটা খাটিয়াতে বসে অনেক কিছু বললো, ওর দুঃখের কথা , আরো অনেক কিছু। সেসব এখানে শেয়ার করা সম্ভব না। সেদিন ও কান্নাকাটিও করেছিল। তার পরের দিন আমি চলে গিয়েছিলাম "নয়ন শ্যামা" র অউটডোরে বাদুড়িয়াতে। সাত দিন পর ফিরে দেখা করতে গিয়েছিলাম ইন্দ্রপুরী ষ্টুডিওতে। ঘরটা অন্ধকার ছিল , আমি নক করে ঢুকলাম। দেখলাম মাথা ভর্তি সিঁদুর। আমি বললাম বাহ্ , দারুন মেকআপ হয়েছে তো !! ও বললো মেকআপ না, আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমি অবাক হয়ে গেলাম , কারণ সাতদিন আগে যা কথা হয়েছে , তাতে এখন বিয়ে হওয়ার কথা ছিল না। বললাম যা হয়েছে ভালোর জন্য।
এর পর আমাদের দেখা সাক্ষাৎ কমে গিয়েছিলো। এক দু বার বোধহয় ওর নানুবাবুর বাজারের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম।
এর পর দেখা "আজ কাল পরশুর গল্প" ফিল্মের শুটে বোলপুরে। সেখানেও একদিন ওর রুমে বসে আড্ডা মারলাম, একই মন কেমন করা গল্প।
মেয়েটা Misunderstood রয়ে গেলো। একটু বোধহয় বেশি লাগাম ছাড়া হয়ে গিয়েছিলো। শেষ দেখা আমার সঙ্গে India Film Labortary তে। সেই সময় ওর হাত ভেঙেছিল। প্লাস্টার নিয়ে এসেছিলো "আজ কাল পরশুর গল্প" র ডাবিংয়ে। ছোট থেকে খালি উপার্জন করে করেই হাঁপিয়ে উঠেছিল। অথচ কি বড় মাপের অভিনেত্রী !

ওর ধারে কাছে যাওয়ার মতো অভিনেত্রী আজ বাংলায় কেউ নেই। একটা বিরাট প্রতিভা অকালে ঝরে গেলো। আর অভিনয় জগৎও হারালো এক অসাধারণ অভিনেত্রী আর ভীষণ ভালো মনের একটা মানুষকে।

কমল বন্দোপাধ্যায়ের ফেসবুক পেজ থেকে মহুয়া রায়চৌধুরী সম্পর্কে

 কমল বন্দোপাধ্যায়ের ফেসবুক পেজ থেকে:-



গতকাল ঠিক যেখানে শেষ করেছিলাম , ঠিক সেখান থেকেই শুরু করি যে সময়ের কথা বলছি অর্থাৎ সত্তর দশক , তখন মোবাইল ফোন কি বস্তু কেউ জানতো না। ল্যান্ডলাইন ফোন তখন যাঁর বাড়িতে থাকতো , তিনি তখন অভিজাত বলেই গণ্য হতেন হ্যা, মহুয়ার কোয়ার্টারেও অবশ্যই ল্যান্ডলাইন ফোন ছিল যেহেতু ওর মা নিজে টেলিফোন দপ্তরের কর্মী ছিলেন ডিপার্টমেন্ট থেকেই ফোনটা বরাদ্দ করা ছিল। তখন ছয় সংখ্যার নম্বর ছিল। নম্বরটাও আমার মনে আছে এখনও। সেটা আর উল্লেখ করছি না কারণ তার প্রাসঙ্গিকতাই আর নেই এখন। মহুয়া সবসময় ডায়েরি মেইনটেইন করতো আমি জানি। কোন তারিখে কোথায় , কখন " কাজ " করতে হবে সেটা লিখে রাখতো এবং বছর শুরুর আগে আমার দায়িত্ব ছিল ডায়েরির প্রথম পাতায় সুন্দর করে ওর নামটা লিখে দেওয়া। তিন-চার রকমের কালি দিয়ে লিখে দিতে হবে। এই কাজটা আমি অন্তত চার-পাঁচ বছর করেছি মনে আছে। আমার হাতের লেখা নাকি খুব সুন্দর ছিল বলেই এই আবদার শুটিংকে সিরিয়াসলিই নিতো বরাবর যে কারণেই চট করে সুখ্যাতি অর্জন করতে পেরেছিল ভেবে দেখুন , মোটামুটি 1972 থেকে 1985- জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মোটামুটি 13-14 বছরে ডাবলু বেশি নয়, মাত্র 94-টা ছবি পুরোটাই , 3-টে ছবি অর্দ্ধসমাপ্ত করে যেতে পেরেছিল। যখন চলে যায় তখন তিনটে ছবির কাজ চলছে , সাতটা ছবি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুটিং শুরু হবে বলে। কোন্ উচ্চতায় তুলে নিয়ে যেতে পারলে এটা করা সম্ভব ? তাও আবার টালিগঞ্জে, বাংলা ছবির জগতে বলিউড নয় কিন্তু অনেকেই জানেন না , উত্তমকুমারের পর ওই ছিল প্রথম " একলাখি " অভিনেতা। উত্তমকুমার নিতেন এক লাখ পঁচিশ -ত্রিশ হাজার টাকা আর 1982-তে মহুয়া নিতো পাক্কা এক লাখ টাকা প্রতি ছবিতে।

☆☆ ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা বলি। ডাবলু বারেবারেই বলতো " দাদা তুই তো আর ভালবাসা-টাসা করলি না তুই তো সম্বন্ধ করেই বিয়ে করবি ঠিক আছে , অসুবিধা নেই। তবে আমি কিন্তু বলে দিচ্ছি , তোর জন্য পাত্রী পছন্দ করার আগে আমি নিজে যাবো , দেখবো কে আমার বৌদি হবে আমার পছন্দ হলে তবেই তুই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে পারবি " তিলক আর পিনাকীও ওর পোঁ ধরেছিল। আমি বলেছিলাম " মাথা খারাপ নাকি রে তোর ? তুই এখন নামিদামী নায়িকা তোকে নিয়ে পাত্রী দেখতে গেলে হুজ্জুতি পড়ে যাবে রে। মেয়ের বাড়ির লোকজন, পাড়াপড়শিরা তো ছেঁকে ধরবে আমাদের উরে ব্বাস, পাত্রী দেখতে মহুয়া রায়চৌধুরী এসেছেন ? পাত্রের তো বিশাল ফিল্ড নায়িকাকে নিয়ে এসেছে মেয়ে দেখতে ? " বাস্তবে কিন্তু সেরকম কিছু হয়নি।

☆☆ আর একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল আমি তখন চাকরি করছি , নাইট সেটে ডিউটি অফিসের ফোন নং ওকে দেওয়া ছিল। তখন লাউঞ্জ বিল্ডিং-এই চাকরি করি আমাদের অফিসে স্টাফ ক্যান্টিন আছে সেটা তখন ছিল উল্টোদিকের হলুদ রঙের D.O. HRO. SRO বিল্ডিংয়ের মধ্যেই। সইসাবুদ করে ক্যান্টিনে গেছি চা খেতে এরকম সময়ে ডাবলু অফিসে ফোন করেছে। ধরেছিলেন সেকশনের বড়বাবু তাঁকে শুধু বলেছিল " কমল ব্যানার্জিকে বলবেন দমদম টেলিফোন কোয়ার্টার থেকে একজন ফোন করেছিল " ভাল কথা , চা খেয়েটেয়ে এসে তো আমরা যে যার কাজে লেগে পড়েছি বড়বাবু ব্যাটা আমাকে বলতেই ভুলে গেছে। তখন প্রায় রাত এগারোটা হবে তখন বড়বাবু আমাকে বলছেন " কমল সন্ধ্যাবেলায় দমদম টেলিফোন কোয়ার্টার থেকে একজন মহিলা তোমাকে ফোন করে খুঁজছিলেন তোমাকে বলতেই ভুলে গেছি " আমি তো বুঝলাম কে করেছে এবার আমার পেছনে সবাই লাগা শুরু করলো কি ব্যাপার? রাতের বেলায় মহিলা ফোন করছেন , তাও বাড়ির কেউ না নিশ্চয়ই কিছু ব্যাপার আছে বাধ্য হয়েই আমি বলেই দিলাম " আপনি এত রাতে আমাকে জানাচ্ছেন? ছিঃ। ছিঃ। কোনও জরুরি দরকার তো থাকতে পারে নাকি ? কে ফোন করেছিল জানেন ? আপনাদের বাংলা ছবির নায়িকা মহুয়া রায়চৌধুরী , আর কেউ নয় কে হয় জানেন ? আমার বন্ধুর বোন " আসলে ডাবলু একটু ভুল করেছিল সেটা হোল যদি নিজের নামটা বলতো যে মহুয়া রায়চৌধুরী বলছি কমল ব্যানার্জিকে চাই। তাহলে সুড়সুড় করে বড়বাবুর মনে পড়ে যেতো অত রাত হতোনা।

অদ্বিতীয়া মহুয়া : ছ'জন অভিনেত্রীর চোখে

রত্না ঘোষাল এগারোই জুলাই বিকেলে মৌ আমার বাড়িতে এসেছিল। এই ঘরে বসেই অনেক আড্ডা হল। সেদিন হেস্পতিবার, 'তপন থিয়েটারে' আমাদের 'নাগ...