শিশু নৃত্যশিল্পী সোনালী থেকে অভিনেত্রী মহুয়ার যাত্রাপথ

 আসর বসেছে উত্তর কলকাতার চৌধুরীপাড়ায়। সে আমলে এমনি অস্থায়ী স্টেজেও স্বনামধন্য শিল্পীরা অংশ নিতেন।



দর্শক আসনে হাজির স্বয়ং সুচিত্রা সেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এবং শ্যামল মিত্রর মতো অদ্বিতীয় শিল্পীরা।

অনেক কষ্ট করে এখানেই জনৈক নীলাঞ্জন রায়চৌধুরী তাঁর ছোট্ট সাত বছরের মেয়ে শিপ্রার নাচ দেখানোর ব্যবস্থা করেছেন।

নীলাঞ্জন এক সময় নিজে উদয়শংকরের দলে নাচতেন, নামী এডিটরের শাগরেদি করেছেন, মায় বম্বে পর্যন্ত পাড়ি দিয়েছেন যশের আশায়, অর্থের সন্ধানে।

লাভ হয়নি।

ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়। কনিষ্ঠা কন্যা শিপ্রা তখন সবে চার বছরের শিশু। তাতে কী! যে কোনও গানের সঙ্গে সে সারা বাড়ি প্রজাপতির মতো নেচে বেড়ায়। স্তম্ভিত হতে হয় তার তালজ্ঞানে!

এক দুঃসাহসী চিন্তা মাথায় এল নীলাঞ্জনের। ক্যারিকেচার আর্টিস্ট বেণু সেন ছিলেন ওঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁকে মনের কথা জানালেন। অতঃপর চৌধুরীপাড়ার আসর।

সেদিনের সেই প্রমোদমেলায় হেমন্ত, সন্ধ্যা, শ্যামলের সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নিল ছোট্ট শিপ্রা।

আর শার্গিদ-এর ঝমঝমে গানদিল ভিল, প্যার প্যার, ম্যায় কেয়া জানু রে তালে তালে জন্ম হল ছন্দিত সোনালি রায়ের।

মন্ত্রমুগ্ধ দর্শকরা সে দিন জানতেও পারেননি তাঁরা এক ইতিহাসের সাক্ষী রয়ে গেলেন। এক তারার জন্মলগ্ন প্রত্যক্ষ করলেন।

বেশ কিছু দিন সোনালি রায় কলকাতা আর তার আশপাশে অস্থায়ী স্টেজ মাতিয়ে রাখল।

পয়সা রোজগারও শুরু হল ওই পুতুলখেলার বয়স থেকেই। তারপর স্টেজ এবং বাবার টালিগঞ্জ পাড়ার যোগাযোগের সুবাদে এক দিন গুটি গুটি পায়ে হাজির হল স্টুডিয়ো পাড়ায়।

সুখেন দাসের প্রযোজনায় পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিচালনায় !নয়া মিছিলছবির জন্যে নায়িকার খোঁজ চলছে।

জহুরি সুখেন দাসের খাঁটি সোনা চিনতে ভুল হয়নি। কিন্তু বিধি বাম। নির্দেশকের ওই চরিত্রের উপযুক্ত মনে হল না রোগাসোগা সোনালি কিংবা শিপ্রাকে।

বাবার হতাশা দেখে ছোট হলেও অপমান বড় বেজেছিল!

স্টুডিয়ো চত্বর ছেড়ে ভগ্নমনোরথ বাপ-মেয়ে বাড়ির পথ ধরেছে। পিছু ডাকলেন সুচিত্রা সেনের ব্যক্তিগত মেকআপ-ম্যান জামালভাই।

খবর পাওয়া গেল তরুণ মজুমদার তাঁর আগামী ছবির জন্যে অল্পবয়সি নতুন মুখ খুঁজছেন। আবার আশার আলো।

কনেবউ সেজে সন্ধ্যা রায়, তরুণ মজুমদারের সামনে দাঁড়াল সদ্য কৈশোর-পাওয়া শিপ্রা ওরফে সোনালি।

মাত্র তেরো বছর বয়স। নামকরণের তখনও কিছু বাকি ছিল। শ্রীমান পৃথ্বীরাজ-এর বউ থেকে প্রেয়সী হবার যাত্রা শুরু হল নতুন নামে।

বাংলা চলচ্চিত্রে নায়িকা অধ্যায়ে নবতম সংযোজনের নামকরণ করা হল মহুয়া রায়চৌধুরী।

কাঁচামাটির তাল নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন সন্ধ্যা রায়! অস্থায়ী স্টেজের অখ্যাত এক রোগাসোগা শিশুশিল্পীকে অপত্য স্নেহে অভিনয়ের পাঠ থেকে শারীরিক যত্নে লালন করা। তবু আজ অনায়াসে বলেন, ওকে কিছু শেখাতে হয়নি। আমি শুধু পড়ে দিলাম। বাকিটুকু নিজেই তরতর করে বলে গেল।

নাচ, অভিনয়, সবই ছিল ওর জন্মগত প্রাপ্তি। দুরন্ত, চঞ্চল তেরো বছরের বালিকা যখন পার্ট বুঝত, চরিত্র শুনত তখন একবারে স্থির এবং আত্মমগ্ন। তাঁর ভাষায় মহুয়া একলিটল গ্লোরিয়াস টুইলাইট

মাধবী চক্রবর্তী ছিলেন তার মাধুমা। ভাত না খেয়ে কাজে বেরোতে পারত না। দূর দমদম থেকে ভোরের কল টাইমে হাজির হতে হলে, নির্দ্বিধায় থেকে যেত মাধুমার কাছে।




‘‘সকাল সকাল দুটো ভাত রান্না করে দিতাম। খেয়ে বেরোত। আমারও শান্তি হত,’’ সেকালের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্না নায়িকা ঘরোয়া মা-মাসির মতোই অপার স্নেহমাখা মুখে বললেন।

বলতে বলতে বিষণ্ণতার আকুল করা ব্যথা চারিয়ে উঠল যেন টলটলে চোখের পাড়ে— ‘‘সাবুর মতো অভিনয়ের ধরন ছিল। অমনি স্বচ্ছন্দ, অমনি আন্তরিক। চলে যাবার পর শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছিল। সেটা তপন সিনহার কাছেই রয়ে গেল। ওর বাড়ির কেউ ওর হয়ে নিতেও আসে নি। অভিমান, অবহেলা নাকি আশঙ্কা? কেউ জানি না।’’

তাপস পাল, সন্তু মুখোপাধ্যায়, রঞ্জিত মল্লিক, দীপংকর দে ছিলেন সমসাময়িক নায়কের দল।

Source: Ananda bazar patrika

মহুয়া রায়চৌধুরী এখনও অমল পালেকারের মনের কোণে বিরাজমান

 




মহুয়া রায়চৌধুরী অমল পালেকারের সাথে দুটি ছবিতে কাজ করেছিলেন, কলঙ্কিনী এবং আদমি ঔর আউরত। 

কলঙ্কিনী ছবিতে মমতা শঙ্করের বিপরীতে ছিলেন অমল পালেকর এবং মহুয়া ও দীপঙ্কর দে জুটি বেঁধেছিলেন। মহুয়ার ভূমিকা তুলনামূলকভাবে ছোট ছিল। আদমি ঔর আউরত ছবিতে মহুয়া এবং অমল পালেকার প্রধান চরিত্রে ছিলেন এবং মহুয়া এই ছবিতে তার ভূমিকার জন্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছিলেন। 


অমল পালেকারের এখনও মহুয়াকে মনে রেখেছেন এবং আনন্দবাজারে একটি সাক্ষাত্কারে অভিনেতা বলেছেন: 


'তিরিশ বছর কেটে গেছে। শূন্যতাটা কিন্তু ভরাট হবার নয়। হলও না। আদমি ঔর আউরত ছোট টেলিফিল্মে অল্প জন আর্টিস্ট। আমি, কল্যাণ (চট্টোপাধ্যায়), মহুয়া...। বিহার-বাংলার বর্ডারে লোকেশন। ছোট্ট ইউনিট উঠেছিল মাইথনে ডিভিসির গেস্টহাউসে। গাড়িতে লম্বা সফরে তিনজন। আমি, তপন সিংহ আর মহুয়া। সারা রাস্তা স্বভাব-চঞ্চল মহুয়া শান্ত বাধ্য মেয়ের মতো চুপচাপ গাড়ির জানলায় থুতনি ঠেকিয়ে বসেছিল।

কী ভাবছিল সারাটা পথ, কে জানে!

এর আগে ওর সঙ্গে আলাপ ছিল না। ছবিটা করার জন্য একটা সখ্য, বোঝাপড়া বড্ড জরুরি ছিল। সেটা তপনদাই গড়ে দিলেন। আমাদের মহুয়া চমৎকার অভিনেত্রী, এইটুকু কথাই যথেষ্ট ওর জন্য।

শুরু হল শ্যুটিং। দিনেরবেলা রুখু লাল মাটি, উঁচুনিচু টিলা, বয়ে চলা নদী ঠেঙিয়ে কাজ করতে হত। ফিরে এসে স্নান করে খোলা বারান্দায় যে যার ড্রিংক নিয়ে সন্ধে শুরু করতাম। দিনগুলোর পিঠে যেন পাখনা লাগানো ছিল।

আমরা একটা গ্যাং ছিলাম। রিয়েল আড্ডা হত। দুষ্টুমি করতে তো গ্যাং লাগে, জোট বাঁধতে হয়। ঠিক তেমনই একটা গ্যাং!

শেষ দিন নিজে হাতে রান্না করেছিল মহুয়া। বাঙালি রান্না। মাছ আর মাছ। খাবার ব্যাপারে আমি মনেপ্রাণে বাঙালি। এই প্রসঙ্গে বলি, আমি বাংলা পড়তে পারি। লিখতেও পারি। তাই বাঙালির সঙ্গে কোথায় একটা আমার আত্মিক যোগ পাই।

তাই সম্পূর্ণ একটা বাঙালি পরিবেশে কাজ করতে গিয়েও সে বার বেশ ভাল লেগেছিল।

কিছুতেই ভোলার নয় সেই সব দিনগুলো। ডাবিং শেষ করে চলে আসার দিন মহুয়া দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল আমায়। দুচোখ টলটল করছিল জলে। এর পরআদমি ঔর আউরত’-এর মতোই আবার আমরা যে যার পথে!

কিন্তু কোনও দিনই ভুলতে পারিনি ওর আলিঙ্গন। ওর উষ্ণতা। ভুলতে পারব না ওর জলে ভরা চোখ দুটো।

দুঃসংবাদটা তপন সিংহই ফোনে জানিয়েছিলেন। তারপর প্রথম যখন কলকাতায় এলাম, ব্যস্ত শহরটা বড় ফাঁকা ঠেকেছিল।

আজও কলকাতা এলে সেই মন খারাপ আমার পিছু ছাড়়ে না। কলকাতা থেকে মহুয়াকে আমি এত দিনেও পুরোপুরি আলাদা করতে পারিনি।


' আনন্দলোক ' - এ ( ২৭ শে জুলাই , ২০০৬ ) অমল পালেকরের মহুয়া রায়চৌধুরীর অকালে চলে যাওয়া নিয়ে আক্ষেপ।



কমল বন্দোপাধ্যায়ের ফেসবুক পেজ থেকে মহুয়া রায়চৌধুরী সম্পর্কে

 কমল বন্দোপাধ্যায়ের ফেসবুক পেজ থেকে:- গতকাল ঠিক যেখানে শেষ করেছিলাম , ঠিক সেখান থেকেই শুরু করি । যে সময়ের কথা বলছি অর্থাৎ ...