আজীবন দমদমের বাসিন্দা। মহুয়া রায়চৌধুরীর দাদা পিনাকী রায়চৌধুরী ওনার বন্ধু ছিলেন , এবং সেই সূত্রে মহুয়া রায়চৌধুরীর সাথে আলাপ ও হৃদ্যতা। অতীতেও মহুয়া রায়চৌধুরীর স্মৃতিচারণ করেছেন এই পেজে।
জীবনের উপান্তে এসে আত্মজীবনী লিখছেন ফেসবুকে। সেখান থেকে মহুয়া রায়চৌধুরীর স্মৃতিকথায়
ভর্তি আরো একটা পর্ব দিলাম আপনাদের জন্য .....
দেখতে দেখতে রজত জয়ন্তী পর্ব্ব পার করে ফেললাম এই স্মৃতিগাথায় । সেই 11 নভেম্বর শুরু করেছিলাম , আর আজ 16 ডিসেম্বর । এখনও আমি কিন্তু সেই সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়েই আটকে আছি । এত ঘটনাবহুল দশক পরপর এসেছে যে বলতে গেলে প্রচুর সময়ের দরকার । বকবক না করে ঘটনাগুলোতে ঢুকে পড়ি , কী বলেন ?
☆☆ পুরো সত্তর ও আশির দশক ছিল জমজমাট । একদিকে পুরোদমে সঙ্গীত জগতে জড়িয়ে যাওয়া , অন্যদিকে চাকরি পাওয়া ও করা , তার আগে স্কুল -কলেজ জীবন শেষ করা -সব যেন একের পর এক চিত্রনাট্য অনুযায়ী চলেছিল।
☆☆ অনেক আগেই কোনও এক পর্ব্বে উল্লেখ করেছিলাম অকালপ্রয়াতা অভিনেত্রী মহুয়া রায়চৌধুরীর কথা । হ্যাঁ , মোটামুটি 1971-72 সাল থেকেই ওঁর সঙ্গে পরিচিতির গন্ডিটা একেবারে খুব কাছের মানুষের মতোই গড়ে ওঠে । সত্তরের শুরু থেকে আমরা পিনাকীর চার-পাঁচ বন্ধুরা ছোট বোনের মতোই দেখেছি , ঠাট্টা-ইয়ার্কি , এমনকী ফুটবল , ব্যাডমিন্টন
খেলেছি বহুদিন । প্রসঙ্গত একটা তথ্য জানিয়ে রাখি , " সাহেব " ছবিটা অনেকেই দেখেছেন আপনারা যে ছবিতে সাহেব মানে তাপস পাল গোলরক্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। নায়িকাবর্জিত ঐ ছবিতে মহুয়াকে কাস্ট করা হয়েছিল তাপসের বোনের চরিত্রে । কেন ? ততদিনে "পারাবত প্রিয়া " ও " দাদার কীর্তি" হয়ে গেছে যে ছবিগুলোতে তাপসের বিপরীতে মহুয়া রায়চৌধুরী তখন " সুপারহিট "। সেই নায়িকার চরিত্র ছেড়ে বোনের রোলে এসেছিল মহুয়া । কেন ? একটাই কারণে । শুনলে অবাক হয়ে যাবেন , তাপসের গোলরক্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করার নেপথ্যে ছিল মহুয়া । মহুয়াই বেশিরভাগ অংশটাতে তাপসের " কোচ " হিসেবে দেখেছি । ও-ই তাপসকে ট্রেনিং দিয়েছিল বেশ কয়েকটা শটে ।
এছাড়াও, ক্যারম খেলাটাও বেশ ভাল খেলতে পারতো । কিন্তু , ক্যারম বা তাস খেলাটা দু চোখে দেখতে পারতো না ।
☆☆ একটা দারুণ মজার বিষয় ছিল লক্ষ্য করার । ও দাদার বন্ধুদের নামের সঙ্গে "দা " শব্দটা জুড়ে নিয়ে সম্বোধন করতো । যেমন , বাবুদা, তপুদা , কালোদা -জাতীয় । কিন্তু আমাকে কেন জানিনা শুধুই "দাদা" বলেই সম্বোধন করতো । একদিন , সেটা বোধহয় ঐ 1976-77 সালেরই কোনও একদিন, আমি ব্যাপারটা খেয়াল করলাম । ওর মা টেলিফোন ভবনে চাকরি করতেন এবং বেশ উঁচু পোস্টেই। দমদম ক্লাইভ হাউসের সামনে যশোর রোডের ওপর টেলিফোন কোয়ার্টার আছে , সেখানে ঢুকেই বাঁহাতের যে কোয়ার্টারটা
আছে তার দোতলায় ওরা থাকতো । তিনটে ঘর ছিল । একটাতে ওর বাবা-মা , একটাতে ও আর একটা একটু ছোট ঘর ছিল যেটাতে পিনাকী থাকতো । আমাদের আড্ডাস্থলই ছিল পিনাকীর ঐ খুপরি ঘরটা।
☆☆"শ্রীমান পৃথ্বীরাজ " হিট হলো । ব্যাস , সাধারণ একটা পুঁচকে মেয়ে হয়ে উঠলো নায়িকা । যে মেয়েটা 1972-এর আগে সাধারণের মতো হেঁটেচলে বেড়াতো , নায়িকা হয়ে যাওয়াতে " সেলিব্রিটি" হয়ে গেল। কোয়ার্টারের ঠিক উল্টোদিকেই মেয়েদের কলেজ " সরোজিনী নাইডু কলেজ ফর উইমেন্স"। অনেকদিন বিকেলে দেখেছি কলেজের অনেক ছাত্রী জমায়েত হতো একসঙ্গে একটিবার হিরোইন মহুয়া রায়চৌধুরীকে
চোখের দেখা দেখবে বলে । কোয়ার্টারের মেন গেটটা দিয়ে ঢুকেই এই দৃশ্য অগুন্তিবার দেখেছি । আর আমি ঐ মেয়েগুলোর মাঝখান দিয়ে ঢুকে সোজা দোতলায়। আমার সত্যিই বলছি খুব হাসি পেতো সেসব দিনগুলোতে। আর মাথায় বদবুদ্ধিও কম খেলতো না তখন। পিনাকীর ঘরটা ছোট হলে কি হবে , ঘরের সামনে উত্তরমুখী বারান্দাটা ছিল। আমরা বন্ধুরা সবসময় ঐ বারান্দায় দাঁড়িয়েই সিগারেট খেতাম।
☆☆ এরকমই দিনগুলোতে যেদিন নীচে কলেজের মেয়েগুলো অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো যদি একবার ঐ বারান্দায় গিয়ে তাদের নায়িকা একবার দেখা দেয় এই আশায়। এটা বেড়ে গেল "পারাবত প্রিয়া " বা "দাদার কীর্তি"র শুটিংয়ের আগে থেকেই। ঐ সময়ে ও তিলককে বিয়েও করে নিয়েছে , "গোলা " হবো-হবো করছে বোধহয়। একদিন আমি ডাবলুকে বলেই ফেললাম " যা না বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেয়েগুলোর দিকে একবার হাসিমুখে হাত নাড়িয়ে আয় না । মেয়েগুলো আনন্দ পাবে । "ও সেদিন আমার কথা রেখেছিল । আমি লাইন থেকে একটু সরে এসেছি ইতিমধ্যেই। যেটা বলছিলাম, সেটা সেরে নি । দাদার বন্ধুদের নামের সঙ্গে " দা" সম্বোধন আর আমি কেন শুধুই "দাদা "? হয়েছিল কি , যতদিন ও নায়িকা হয়নি ততদিন ও সবার বোন হয়েই ছিল। কিন্তু, যেই নায়িকা হয়ে উঠলো , সত্যিই বলছি আমাদের বন্ধুদের মধ্যে বেশ পরিবর্তন এসে গেল । সবাই ওকে ঐ নায়িকা নায়িকা ভাবেই দেখতে শুরু করলো । আমি চিরকালই খুব সিধাসাধা ছিলাম , জীবনের শেষদিন পর্যন্তও তাই থেকে যাবো । আমি খেয়াল করিনি " ডাবলু " কিন্তু বুঝেছিল । তাই আমি যেদিন ওকে জিজ্ঞাসাটা করেছিলাম যে আর সবাইকে নামের সঙ্গে দা জুড়ে কথা বললেও আমি কেন শুধুই দাদা ? উত্তরটা সপাটে দিয়েছিল ," কেন ? কারণ তুই আমাকে এক সেকেন্ডের জন্যও হিরোইন ভাবিস না , বোন ভাবিস , তাই তুই শুধুই দাদা "। হ্যা , এটা চরম বাস্তব যে ওকে আমি নায়িকা হিসেবে ভাবিইনি এক মূহূর্তের জন্যও। তাই , ও যেদিন "দাদার কীর্তি"র সাফল্যে উৎফুল্ল তখন বলেছিল "কি রে দাদা , এবার তো মানবি নাকি যে আমি একটু হলেও অভিনয়টা পারি "? আমি সেদিনও বলেছিলাম "তুই যেদিন বিদেশ থেকে স্বীকৃতি আদায় করে আনতে পারবি সেদিন বলবো তুই অভিনেত্রী "। বিশ্বাস করুন , আমার "ডাবলু " , আপনাদের মহুয়া রায়চৌধুরী সেই চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিল বেশ রাগতভাবেই । বলেছিল " তুই কিন্তু আমাকে চিনিসনি এখনও । আমি তোর চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্ট করলাম । তোকে দিয়ে বলিয়েই ছাড়বো যে মহুয়া রায়চৌধুরী একজন অভিনেত্রী ।" কি পোড়া কপাল আমার , আমি জীবনে সেই সুযোগটা আর পেলামই না । যেদিন " আদমি আউর অওরত "-এর জন্য পুরস্কারটা পেলো , তার অনেক আগেই ও আমাদের সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চিরকালের মতো মহাপ্রস্থানের পথে রওনা দিয়েছে । সামনাসামনি স্বীকার করার সুযোগটুকুও দিলি না ডাবলু । খুব খারাপ করলি কিন্তু । জানিস ডাবলু রাগে , দুঃখে , কষ্টে , যন্ত্রণায় তোর সঙ্গে তোলা চল্লিশ-বিয়াল্লিশটা ছবিও তোর মতোই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিয়েছি রে । রাগ করিস না । ঠোঁট ফোলাবি না কিন্তু । তুই তার বদলে কটা কিল মেরে যা , আমি সেই আগের মতোই হেসেই যাবো । তারপরই তুই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলবি । আমি পকেট থেকে চকোলেট বের করে তোর হাতে ধরিয়ে দেবো। এক মিনিটের মধ্যে কান্না উধাও হয়ে প্রভাতী সূর্যের মতো খিলখিল করে হাসবি আর মাথা দোলাবি । তোর খোলা চুলের ঝাপটা এসে পড়বে তোর দাদার মুখচোখে।
আজ এই পর্যন্তই থাক । খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। চোখ জলে ভিজে যাচ্ছে লিখতে পারছি না।