অজানা মহুয়া রায়চৌধুরী- আজ পর্যন্ত তার মৃত্যু রহস্যময়

 


১৯৮৫।

সে এক আষাঢ় শেষের বেলা। বিরামহীন বৃষ্টি।

দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত নার্সিং হোমের আট তলায় ৭২২ নম্বর ঘর।

ঝলসানো শরীর অস্ফুট উচ্চারণে শুধু কয়েকটা শব্দ শোনা গিয়েছিল, ‘‘আমার গোলা রইল। ওকে দেখিস।’’

না, কোনও প্যারালাল সিনেমার দৃশ্য নয়।

এ এক জীবনের দলিল।

যে জীবনের নাম মহুয়া রায়চৌধুরী।

‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এ ঘোড়সওয়ার হয়ে যে মেয়েটা বাংলা ছায়াছবিতে এসেছিল। সে এক আবির্ভাব যেন!

এক্কেবারে আসা, দেখা, জয় করা। তবে কিনা নিজস্বতা বজায় রেখে। তার পরই দ্রুত প্রস্থান।

ঘোর বর্ষামুখর রাতেই ভয়ঙ্কর ভাবে আগুনে পুড়ে এগারোটা দিন মৃত্যুর সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধ শেষ করে অগুনতি মানুষকে চোখের জলে ভাসিয়ে বিদায় নিয়েছিল সে।

চলে গিয়েছিল স্বামীপুত্রের ভরাট সংসার ফেলে, বাংলা চিত্রজগতের নির্দেশক প্রযোজকদের এক গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে।

ঠিক তার আগে প্রাণের বন্ধু মাটুর হাত ধরে সাত বছরের গোলার কথা বলে যেতে পেরেছিল শুধু।

আত্মহত্যা না হত্যা?

নাকি নিছকই দুর্ঘটনা?

এ সংশয় রয়ে গেছে আজও।

ফেরা যাক বহু যুগ আগের সেই সন্ধেবেলায়।

‘দাদার কীর্তি’। তাপস পাল প্রথম ফ্লোরে এলেন। এতটাই কাঁচুমাচু জড়োসড়ো ভঙ্গি, যে পাঁচ বছরের শিশুটিও মুখের ভাষা পড়ে ফেলেছিল।

‘‘প্রথম প্রথম সকলেরই একটু অমন হয়। পরে সব ঠিক হয়ে যায়।’’

কার আশ্বাসবাণী?

নবাগত ছেলেটি অবাক হয়ে ফিরে দেখে, বাংলা ছবির ব্যস্ততম নায়িকার মুখ!

ছবিতে মহুয়ার ছোট বোন ছিল দেবশ্রী, স্টুডিয়োপাড়া যাকে চেনে চুমকি নামে। গোপন কথা, বকাবকি, আদর, মান-অভিমান সবটা জড়িয়ে অজান্তেই কখন যেন চুমকির ‘দিদি’ হয়ে যান মহুয়া।

একবার রীতিমত মনকষাকষি। আশেপাশে যাঁরা ওঁদের জানতেন, তাঁদের আশংকা নায়িকার সঙ্গে নায়িকার এমন বিরল সদ্ভাব এ বার বুঝি আর থাকে না! কিন্তু মহুয়া তো মহুয়াই।

কখন যে ঝোড়ো হাওয়ার মতো সব উড়িয়ে দু’হাত দিয়ে ফের আগলে ধরলেন তাঁর অভিমানী ‘বোন’-কে, টেরই পাওয়া গেল না।

মহুয়ার সব নায়ক অবশ্য আজ আর তাঁর প্রতি সমান সহমর্মী নন। এঁদেরই এক জন তো মহুয়া প্রসঙ্গে লেখালেখির যথার্থতাই খুঁজে পেলেন না। প্রায় ঠাট্টা করেই উড়িয়ে দিলেন।—‘‘মহুয়া! এটা একটা বিষয় হল!’’

মহুয়াকে স্বহস্তে যাঁরা প্রায় রচনা করেছেন, তাঁদের মধ্যেও কেউ আবার ওঁর সম্পর্কে একান্তই ব্যক্তিগত স্মৃতি ‘বাজার’-এ এনে ফেলতে চাইলেন না। কেউ যেন এড়িয়ে গেলেন।

ভয়? আজও? অনিশ্চয়তা এখনও? পাছে নিশ্চিত জীবনে বেয়াড়া আঁচ়ড় লেগে যায়! কে জানে!

প্রেম ছাড়া না কোনও শিল্প হয়, না কোনও শিল্পী বাঁচে! এক রত্তি মহুয়াও প্রেমে পড়ছিল তিলকের।

কিশোরকণ্ঠী তিলক তখন স্টেজে গান গায়। কোনও এক বৈশাখের দখিন হাওয়ার দোলায়, নাকি সেই প্রহর শেষের চৈত্রের রাঙা আলোয় দেখা হয়েছিল, সে আজ সময়ের অতলান্তে হারিয়ে গিয়েছে। বাড়ির মত ছিল না। এ দিকে বাঁধা পথে চলবার মেয়ে সে যে নয়। সহায় তখন মাটু। জনগণের চোখে যিনি কিনা অভিনেত্রী রত্না ঘোষাল। উজিয়ে এলেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, তরুণকুমার... আরও অনেকে।

মেয়ের এই সিদ্ধান্ত বাবা মেনে নেননি। কেন নেননি? কেউ বলেন, মেয়ের সামনে তখন প্রসারিত ভবিষ্যৎ। অপরিমেয় কাঞ্চনযোগ। অতি সাধারণ মধ্যবিত্তের পক্ষে তার হাতছানি অগ্রাহ্য করা নিশ্চিত কঠিন। এ ছাড়া রঙিন পৃথিবীর কাজল যার চোখে, খ্যাতির মোহপাশ সে বড় সহজে কাটাতে পারে না।

শিপ্রা থেকে মহুয়ার যাত্রাপথের যে আয়োজন স্বহস্তে করেছিলেন, তার ‘ভাগিদার’ মেনে নেওয়া হয়তো’বা সেদিন সম্ভব ছিল না নীলাঞ্জনের। হার মানলেন জেদি মেয়ের কাছে!

তিলকদের হেদুয়ার পুরনো বাড়ি। তুলনায় সচ্ছল। ব্যাংকের চাকুরে। শুরুটা ছিল ভারী সোহাগের। তিলকের দাদা অলোক চক্রবর্তী ওঁদের দুজনকে নিয়ে প্রযোজনা করলেন ‘আনন্দমেলা’। ছবি চলল না। কিন্তু মহুয়ার ডাক আসতেই লাগল অন্য পরিচালকদের কাছ থেকে। দু’জনে মিলে উঠে এল টালিগঞ্জের বাসাবাড়িতে। অল্প বয়স। বায়োস্কোপের পাত্রপাত্রী। মাঝরাতে বাইকভ্রমণ। মদ্যপান। ফুর্তির ফোয়ারা। এরই মধ্যে এল ফুটফুটে পুত্রসন্তান।

শিশুশিল্পী হিসেবে বাদশা ছবিতে তিলকের আত্মপ্রকাশ। সুখেন দাস-এর ‘প্রতিশোধ’-এ দু’জনে একসঙ্গে অভিনয় করে। উত্তমকুমারের বিপরীতে ‘সেই চোখ’, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে ‘মাটির স্বর্গ’। ‘হার মানিনি’ উত্তমকুমারের সঙ্গে অসম্পূর্ণ ছবি। কারণ উত্তমকুমারের মৃত্যু।

প্রথম জীবনে রোগা বলে বাদ পড়েছিলনয়া মিছিলথেকে। বুকের মধ্যে সেই তুষের আগুন নিভতে দেয়নি। তাই পৃথুলা বলে যখন তপন সিংহআদমি ঔর আউরতথেকে বাদ দেবেন বলে ঠিক করলেন, মহুয়া মাত্র তিন সপ্তাহ সময় চেয়েছিল। যথাসময়ে যখন তপন সিনহা তাকে দেখে, এক রকম অবাক হতেও ভুলে গিয়েছিলেন।

দামাস্কাস আন্তর্জাতিক চলচিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জয় করে বৃত্ত যখন সম্পূর্ণ করল, তত দিনে শুধুমাত্র চন্দ্রাভ সে মুখের স্মৃতিভারটুকু রেখে পুরস্কারের পাশেমরণোত্তরকথাটুকু বসিয়ে দিয়ে মহুয়া চলে গেছে চিরকালের মতো। সব মায়ার পারে।

মহুয়ার হাতে কুড়িটা ছবি ছিল তার অকালপ্রয়াণের সময়।

জুলাই-এর পর বাংলাদেশ চলে যাওয়ার কথা। মমতাজ আলমেরঊশীলাছবির নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করবার আয়োজন সম্পূর্ণ। অপেক্ষা শুধু ভিসা পাওয়ার।

সংশয় সন্দেহ আজও - মৃত্যুকালীন জবানবন্দি নেন এনসি বন্দ্যোপাধ্যায়, ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেণ্ট পুলিশ, সিআইডি এবং এএন দুবে, ইন্সপেক্টর। সাক্ষী হিসেবে সই করেন দাদা পিনাকী রায়চৌধুরী এবং সিস্টার ঊষা। উপস্থিত ছিলেন রত্না ঘোষাল।

বহু সংশয়ের নিষ্পত্তি আজও হয় নি। সেই সময়কার সংবাদমাধ্যমে ধরা আছে অগুনতি পরস্পরবিরোধী তথ্য।

মাঝরাত অতিক্রান্ত।

বাড়িতে দুজন পরিচারক। তবু মহুয়া নিজে খাবার বা দুধ গরম করতে গেল কেন?

তিলক কিন্তু ডিনারের পরেই দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছিল। মহুয়ার কথামতো তার অসাবধানতাবশত যদি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে বাড়িতে চারজন মানুষের উপস্থিতি সত্ত্বেও কী করে এমন ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছিল?

স্টোভ বার্স্টের একটা তত্ত্ব পরিবারের তরফ থেকে বার বার খাড়া করা হয়েছে। পুলিশ অত্যন্ত কম কেরোসিন ভরা একটি স্টোভ রান্নাঘর থেকে প্রায় অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে, যেটা কোনও ভাবে কোনও দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে বলে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি।

পিঠে এবং শরীরের আরও কয়েক জায়গায় কালশিটের দাগ পাওয়া যায় যার কোনও সদুত্তর মেলেনি।

মহুয়ার মুখের ডান দিকে একটা ক্ষতচিহ্নের বিচিত্র ব্যাখ্যা মেলে বাবার কাছে।কোনও কাপড়ের টুকরো আটকে যায় দুর্ঘটনার সময়, যেটা টেনে তুলতে গেলে মহুয়া ব্লেড দিয়ে কেটে নিতে বলে আর তাতেই নাকি এই বিপত্তি।

প্রায় সত্তরভাগ অগ্নিদগ্ধ মানুষের পক্ষে কি সম্ভব?

রান্নঘর এক রকম অক্ষত। অথচ শোবার ঘরে লেপ তোষক মায় বালিশ পর্যন্ত পোড়া।

নাইটি এবং বিছানায় এত কেরোসিনের গন্ধ কোথা থেকে এসেছিল?

স্টোভ বার্স্ট করলে পিঠ, তলপেট, ঊরু এমন ভয়াবহ দগ্ধ কেন?

নীলাঞ্জনের মাত্র তিনটি আঙুলের ডগায় সামান্য চোট ছিল। তিলক অক্ষত। শুধুমাত্র খুঁড়িয়ে হাঁটছিল।

অনেকেই মনে করেছিলেন, অমন মারাত্মক আগুন থেকে বাঁচাতে গেলে এক রকম অসম্ভব।

পরিবারের তরফ থেকে কোনও এফআইআর করা হয়নি। শোনা যায়, তদন্ত চলার কিছুদিনের মধ্যে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তা বন্ধের নির্দেশ আসে!

কিন্তু কেনআজও জানা নেই তাও।

চূড়ান্ত অভিযোগ

ব্যক্তিগত ভাবে মাধবী চক্রবর্তী জানান মহুয়ার মৃত্যুর অনতিকাল পরে তার বাবা স্মরণসভা আয়োজন করবার প্রস্তাব নিয়ে তাঁর কাছে আসেন। মৃত্যুর যথোচিত কারণ না জানা পর্যন্ত ধরনের কোনও সভায় তিনি অংশগ্রহণ করবেন না বলে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।

দশ বছর পর প্রদেশ মহিলা কংগ্রেস আয়োজিত আন্তর্জাতিক নারীদিবস উপলক্ষে মাধবী চক্রবর্তী তাঁর ভাষণে মহুয়া রায়চৌধুরীকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ তোলেন।

মহুয়ার ফুটবলপ্রীতি ছিল যখন শিপ্রা, তখন থেকে। দাদা যখন মাঠে খেলতে যেত পিছন পিছন সঙ্গ নিত ছোট বোন। মন দিয়ে খেলা দেখত মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে। কখনও খেলোয়াড় কম পড়লে নিজেই মাঠে গোল আগলে দাঁড়াত। অন্য দলের এগিয়ে আসা প্লেয়ারদের রীতিমত শির-ফোলানো গলায় শাসাত। —‘‘খবরদার! যদি আমাকে গোল দিয়েছিস। দেখে নেব, পরে।’’ কী দুর্জয় সাহস! টগবগে প্রাণ! কী নিবিড় মনের বেড়। যা আমার, তা আমারই। জীবনে-মরণে, সতে-অসতে আমি তাকে রাখব।

ইস্টবেঙ্গল হেরে গেলে মাথা কুটে কাঁদে। আর তার আবেগের আধার? সে যেন অকুল দরিয়া! অসীম, অনন্ত। যা কিছু আপন, তার জন্য জান কবুল আর মান কবুল।

পেলেকে নিয়ে কসমস ফুটবল দল এল কলকাতায়। মোহনবাগানের সঙ্গে খেলতে। ৭৭ সাল। গড়ের মাঠে খেলা হল সেপ্টেম্বরের চব্বিশ। মায়ের জন্মদিনের দিনই ভূমিষ্ঠ হল মহুয়ারগোলা। চতুর্দিকেরগোল গোলআওয়াজের তোড়ের মধ্যে যে মায়ের কোল আলো করল, পাঁড় ফুটবল ভক্ত তার কী নাম দেবে?— ‘গোলা

মহুয়া নায়িকা হয়েও দর্শকের কাছের মানুষ। ওর সাধাসিধে স্বতঃস্ফূর্ত আনাগোনা চলাফেরার মধ্যে একটা আটপৌরেপনা থেকেও কোথায় যেন সে অনন্যা। তত দিনে তিলক-মহুয়া উঠে এসেছে বেহালায়। সব বিবাদ চুকিয়ে বাবাও এসে বাস করতে শুরু করেছেন মেয়ের ঘরে। কচি গোলাকে দেখভাল করতে হবে তো! কিন্তু তাতেও জীবন সুরে বাজল কই!

দুনিয়ার সব আলো তখন মহুয়ার জন্য। আশেপাশের কেউই সেই ছটার ধারেকাছেও নেই। প্রযোজকঅগ্রগামীথেকে নির্দেশক নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়, তপন সিংহ সবাই ওর কথা ভাবতে শুরু করেছেন।

ওই মায়াময় দুটো চোখ, ঝিকিয়ে ওঠা হাসি, এক ঢাল চুল, ভেসে থাকা এক পানপাতা মুখ।সবটা মিলে যেন ঠিক মানবী নয়!

Source: Ananda bazar patrika

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কমল বন্দোপাধ্যায়ের ফেসবুক পেজ থেকে মহুয়া রায়চৌধুরী সম্পর্কে

 কমল বন্দোপাধ্যায়ের ফেসবুক পেজ থেকে:- গতকাল ঠিক যেখানে শেষ করেছিলাম , ঠিক সেখান থেকেই শুরু করি । যে সময়ের কথা বলছি অর্থাৎ ...